রাজধানীতে ফের রেস্তোরাঁয় ঘটল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এবার উত্তরায় অবস্থিত ‘লাভলীন রেস্টুরেন্টের’ অগ্নিকাণ্ডে বেইলি রোডে রেস্তোরাঁর মতো কোনো মর্মান্তিক মৃত্যুর সংবাদ আমাদের শুনতে হয়নি। তবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও নিহত-আহতের ঘটনা যতই ঘটতে থাকুক না কেন, রেস্টুরেন্টগুলোয় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাসহ সব ধরনের নাজুকতার অবসান হবে না!
রোববার কালবেলায় প্রকাশিত ‘বেইলি রোডের কান্নাতেও কারও ‘ঘুম’ ভাঙেনি’ শীর্ষক প্রধান শিরোনামে এ বিষয়ে যে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা অত্যন্ত হতাশার ও উদ্বেগের। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তরার এ ঘটনায় বহুতল আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা রেস্তোরাঁটিতে ছিল না ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। পাশাপাশি ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ—এমন নোটিশ দেওয়া হলেও কর্ণপাত করেনি কর্তৃপক্ষ। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের চিত্র একই। সংশ্লিষ্টদের বরাতে জানা যাচ্ছে, তারকাচিহ্নিত হোটেল ছাড়া দেশে রেস্তোরাঁর প্রকৃত সংখ্যা কত, সেই হিসাব কোনো সংস্থার কাছেই নেই। এ নিয়ে কখনো হয়নি সমীক্ষা বা জরিপ। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির খসড়া হিসাবে দেশে ৫ লাখের মতো রেস্তোরাঁ রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই আছে প্রায় ২৫ হাজার। এই সংখ্যার মধ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। আর দুই সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে প্রায় ৭ হাজার রেস্তোরাঁ। অবশ্য বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সদস্য রয়েছে ২ হাজার ৭০০। সব সংস্থাই মোটা দাগে বলছে, তারকা মানের হোটেল-রেস্তোরাঁ ছাড়া ঢাকায় অবস্থিত আর কোনো রেস্তোরাঁর শতভাগ অনুমোদন নেই। সমিতিভুক্ত সব রেস্তোরাঁরও অনুমোদন নেই। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এটিই বাস্তবতা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অথচ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই রাজধানীর বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় ঠাসা গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশত মানুষ প্রাণ হারান। এরপর ঝড় ওঠে সমালোচনার। শুরু হয় কর্তৃপক্ষের দৌড়ঝাঁপ। তখন বেরিয়ে আসে ভবনটিতে থাকা রেস্তোরাঁগুলোর অনুমোদনহীনভাবে গড়ে ওঠার তথ্য। সে সময় এসব অবৈধ রেস্তোরাঁ বন্ধে আসে নানা সুপারিশ। শুরু হয় অভিযান। তবে সেই দৌড়ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায় মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই। কর্তৃপক্ষের ‘ঘুমিয়ে’ যাওয়ার সুযোগে ‘মৃত্যুকূপ’ হয়ে গড়ে ওঠা অনুমোদনহীন রেস্তোরাঁগুলো দিব্যি চলছে। উচ্চ আদালত থেকেও অনুমোদনহীন সব রেস্তোরাঁয় অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশনা ছিল। সিলগালা অনেক রেস্তোরাঁও ফের চালু হয়েছে। রেস্টুরেন্ট চালু করতে হলে সরকারি অন্তত ১২টি সংস্থা বা দপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান কি তাদের দায় এড়াতে পারে? রাজউকের নিয়মিত অভিযান বন্ধ, ফায়ার সার্ভিসের নোটিশকে পাত্তা দেওয়া হয় না। আবার বিদ্যুৎ-গ্যাস লাইন ঠিক আছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট যে বিভাগগুলোর, তাতে ভাটা। স্থানীয় প্রশাসন সিটি করপোরেশনের নেই তৎপরতা। এ ছাড়া বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও দেদার তা চলছে। সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা; যেখানে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা, আন্তরিকতার অভাব ও সমন্বয়হীনতার ছাপ স্পষ্ট।
আমরা মনে করি, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের রেস্তোরাঁগুলোয় এসব অনিয়ম ও ভগ্নদশার জন্য সরকার সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার দায়িত্বহীনতা, আন্তরিকতার অভাব এবং সমন্বয়হীনতাই প্রধানত দায়ী। এ ক্ষেত্রে ভবন ও রেস্তোরাঁ মালিকদের সচেতনতা ও সতর্কতাও অত্যন্ত জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা, সংশ্লিষ্ট সবার ঘুম ভাঙবে। সারা দেশে রেস্তোরাঁয় অগ্নিঝুঁকি এড়াতে এবং বিরাজমান অনিয়ম দূর করতে নেওয়া হবে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ।