বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর মানুষ আনন্দ এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করে আসছে। বহির্বিশ্বে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে থেকে নববর্ষ উদযাপন করা হয়। এ সময় আতশবাজি, ফানুস ওড়ানো, বড় কনসার্ট এবং আলোকসজ্জার মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। নিউইয়র্ক সিটির টাইমস স্কয়ার থেকে শুরু করে লন্ডনের থেমস নদীর তীর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে নতুন বছরের আগমনকে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশেও এই উৎসবের আমেজ বিদ্যমান। ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নববর্ষের আগের রাতে আতশবাজি, ফানুস ও আলোকসজ্জার মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। তবে, এই উদযাপন আনন্দদায়ক হলেও এর ফলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তা এখন অত্যন্ত চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব এই উদযাপনের অন্যতম অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল।
নববর্ষ উদযাপন শুধু একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, এটি পরিবেশের ওপর একাধিক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। আতশবাজি এবং ফানুস ওড়ানোর সময় ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন পটাশিয়াম পারক্লোরেট, বেরিয়াম নাইট্রেট এবং সালফার ডাইঅক্সাইড বায়ুতে মিশে গুরুতর বায়ুদূষণ ঘটায়। ২০২৪ সালের নববর্ষ উদযাপন নিয়ে ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, নববর্ষের প্রথম ঘণ্টায় বায়ুর মান উল্লেখযোগ্যভাবে অবনতি হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, বস্তুকণা২.৫ দূষণ রাত ১১-১২টার মধ্যে প্রতি ঘনমিটারে ২৪৯ মাইক্রোগ্রাম রেকর্ড করা হয়, যা বায়ুমান সূচকে (AQI) অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত। এ ধরনের দূষণ শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। শব্দদূষণ নববর্ষ উদযাপনের আরেকটি গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আতশবাজি এবং পটকা ফোটানোর শব্দের মাত্রা ৮০-৯০ ডেসিবল অতিক্রম করে, যা মানুষের শ্রবণশক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ক্যাপসের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার সময় শব্দের তীব্রতা ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। শব্দদূষণের ফলে শুধু মানুষ নয়, পশুপাখিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাখিরা আতঙ্কিত হয়ে উড়তে গিয়ে গাছে বা দেয়ালে আঘাত পেয়ে আহত হয় বা মারা যায়। এই উদযাপন পরিবেশের অন্যান্য উপাদানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বায়ুদূষণের কারণে গাছপালা স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মাটির পুষ্টি হারানোর ঝুঁকি বাড়ে। দীর্ঘস্থায়ী বায়ু দূষণের প্রভাবে মাটিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি বাড়তে পারে, যা কৃষিকাজ এবং খাদ্য উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। তদুপরি, শব্দ দূষণের কারণে বন্যপ্রাণীর আচরণে পরিবর্তন ঘটে, যা প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার দিকে পরিচালিত করে।
ক্যাপসের গবেষণায় গত সাত বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নববর্ষ উদযাপনের ফলে বায়ু ও শব্দদূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর এবং ১ জানুয়ারির মধ্যে বায়ুমান সূচকের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ২০১৭-১৮ সালে বায়ুমান সূচক ছিল ১৯০, যা ১ জানুয়ারিতে বেড়ে গিয়ে ৩১৫ তে উন্নীত হয়েছে অর্থাৎ ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৮-১৯ সালে এই বায়ুমান সূচক বৃদ্ধির হার ছিল ২৩ শতাংশ, যেখানে বায়ুমান সূচক ১৯৫ থেকে ২৪০ উন্নীত হয়েছিল। ২০১৯-২০ সালে বায়ুমান সূচক ছিল ২৩৩ এবং ৩১৯, যা ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০২০-২১ সালে তুলনামূলক কম ৭ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গেছে। তবে, ২০২১-২২ সালে AQI পার্থক্য ছিল বিপরীতমুখী, যেখানে দূষণের মাত্রা ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। ২০২২-২৩ সালে আবার ৬ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় এবং ২০২৩-২৪ সালে বায়ুমান সূচকের ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটে। শব্দদূষণের ক্ষেত্রে, ২০১৭-১৮ সালে ৬৯ শতাংশ সময় শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবল অতিক্রম করেছিল, যা ২০২৩-২৪ সালে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২১-২২ সালে করোনা মহামারির কারণে তুলনামূলক কম দূষণ লক্ষ্য করা গেছে। তবে সামগ্রিকভাবে, প্রতি বছর নববর্ষ উদযাপনের সময় শব্দদূষণের মাত্রা মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছায়।
২০২১ সালে আতশবাজি ও ফানুসের কারণে ১৬টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪.৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আতশবাজির উচ্চ শব্দের কারণে মাহমুদুল হাসান নামে এক শিশুর মৃত্যু ঘটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আজ জানিয়েছে যে ২০২২ সালের নববর্ষ উদযাপনের সময় ফানুস এবং আতশবাজির বিস্ফোরণের কারণে অন্তত ১০০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২৩ সালে ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী ফানুসের কারণে সারা দেশে ১০০টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যার মধ্যে সাতটি ঘটনাই রাজধানীতে সংঘটিত হয়। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে জরুরি হটলাইন ৯৯৯-এ আতশবাজি থেকে সৃষ্ট শব্দদূষণ নিয়ে ৩৬৫টি অভিযোগ জমা পড়ে, যার মধ্যে ১৬০টি অভিযোগ রাজধানী থেকে করা হয়।
নববর্ষ উদযাপন পরিবেশের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা রোধ করতে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। প্রথমত, আতশবাজি এবং পটকার পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারের প্রচলন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। নববর্ষ উদযাপন এবং এর ফলে সৃষ্ট দূষণের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে, নবীন প্রজন্মের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল এবং কলেজে কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগে কঠোরতা আনতে হবে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, রাতে ৫০ ডেসিবলের বেশি শব্দ করা নিষিদ্ধ; কিন্তু নববর্ষের রাতে এই মানদণ্ড মানা হয় না। সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এই বিধিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, দূষণ সৃষ্টিকারী আতশবাজি এবং ফানুস বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। পশুপাখি এবং বন্যপ্রাণীর সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, নববর্ষ উদযাপনের সময় প্রাণীদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করা যেতে পারে। গৃহপালিত প্রাণীদের নিরাপদ স্থানে রাখা উচিত এবং বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থলের কাছাকাছি উদযাপন সীমিত করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য স্থানীয় সরকার এবং পরিবেশ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করা জরুরি। দূষণ নির্ধারণ এবং এর প্রতিরোধে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা উচিত। এ ছাড়া, নববর্ষ উদযাপনের বিকল্প পন্থা উদ্ভাবন এবং তা বাস্তবায়নে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
নববর্ষ উদযাপন আমাদের জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে এলেও এর ফলে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এবং প্রাণিজগতের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জকে আরও জটিল করে তুলেছে। তাই, আমাদের উচিত উদযাপনের ধারায় পরিবর্তন এনে একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব উপায় গ্রহণ করা। জনসচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং পরিবেশবান্ধব উদযাপন পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা নববর্ষ উদযাপনকে আরও বেশি সার্থক করতে পারি।
লেখক: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)