মরণব্যাধি ক্যান্সারের নাম শুনলেই সন্ত্রস্ত হতে হয় সবাইকেই। কেননা এ রোগ একবার কারও শরীরে বাসা বাঁধলে একদিকে তার বাঁচার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ; অন্যদিকে এর ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ভার বহনের দুশ্চিন্তায় হতে হয় ভারাক্রান্ত। আক্রান্ত ব্যক্তিসহ তাদের পরিবারের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর পরিণতি হয় মর্মান্তিক। দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসাভার বহন করে তারা সহায়সম্বলহীন, অসহায় হয়ে পড়েন। মূলত এসব বিবেচনা করেই সর্বসাধারণের জন্য এ চিকিৎসায় আমাদের দেশে রয়েছে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি ব্যবস্থাপনা। কিন্তু গভীর দুঃখ ও হতাশার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় গুরুত্বপূর্ণ যে রেডিওথেরাপি, তা সরকারি পর্যায়ে এই মুহূর্তে কার্যত বিকল!
রোববার কালবেলায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে ২০২০ সালের একটি জরিপের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এ রোগে মৃত্যু হয় লক্ষাধিক মানুষের। অথচ দেশের খোদ জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সারের রেডিওথেরাপিতে ব্যবহৃত যে ছয়টি যন্ত্র, তার সবই নষ্ট! চারটি যন্ত্র আগে থেকেই নষ্ট। বাকি দুটি যন্ত্রের একটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল, আরেকটিতে কোনোরকম সেবা দেওয়া হতো। এক সপ্তাহ ধরে সেই দুটিও বন্ধ হওয়ায় হাসপাতালটিতে বন্ধ রয়েছে এ চিকিৎসা। শুধু এখানেই নয়, সারা দেশের চিত্র প্রায় একই। এ যন্ত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি, বগুড়া, ময়মনসিংহ, রংপুর ও বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি করে যন্ত্র থাকলেও সবকটি বর্তমানে বিকল। রাজশাহী, ফরিদপুর ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি করে লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র থাকলেও দীর্ঘদিন পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়। শুধু চট্টগ্রাম ও সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুটি যন্ত্র রয়েছে সচল।
সরকারি হাসপাতালে রোগীরা যেন সাশ্রয়ে সেবাটি পেতে পারেন, সে লক্ষ্যেই নেওয়া হয় এসব উদ্যোগ। ফলে একজন রোগীকে রেডিওথেরাপির একটি কোর্স সম্পন্ন করতে যদি ছয়বার থেরাপি নিতে হয়, তাহলে সরকারি হাসপাতালে তার ব্যয় সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে (কোবাল্ট-৬০) একই সেবা পেতে তাকে গুনতে হয় কমপক্ষে ৮৭ হাজার টাকা। সামর্থ্যবানরা সেবাটি পেতে বেসরকারি হাসপাতালে গেলেও দরিদ্র রোগীদের পক্ষে তা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে এই মুহূর্তে হাজার হাজার ক্যান্সার রেডিওথেরাপি না পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যান্সার রোগীদের চার ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। শল্যচিকিৎসা, কেমো, রেডিও ও হরমোনথেরাপি। নির্ধারিত সময়ে যদি কোনো একটার ব্যত্যয় ঘটে, সে ক্ষেত্রে ক্যান্সার ফিরে আসে। রোগী মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন। মারাও যান।
বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবদের চরিত্র নিধিরাম সর্দার। মূলত শূন্যহাতে মুখে মুখে তার বাহাদুরি ও আস্ফালন দেখাতেন। যেদিন তার গ্রামে ডাকাত পড়ল, তিনি কিছুই করতে পারলেন না। তবে সেদিনও বললেন, ডাকাতরা বেঁচে গেছে, তার কাছে ঢাল-তলোয়ার কিছু ছিল না। থাকলে দেখে নিতেন, তারা কত বড় ডাকাত! গল্প বা প্রবাদের নিধিরাম তবুও একটি অজুহাত দেখাতে পেরেছিলেন। জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল কী অজুহাত দেখাবে? তাদের তো সবই ছিল। তারা এর যত্ন-প্রয়োগ ও ব্যবহারই ঠিকঠাকভাবে করতে পারেনি। অথচ নিধিরামের মতো নাম ধারণ করে আছে ক্যান্সারসেবা প্রতিষ্ঠান! দায় আসলে কার? নিশ্চিতভাবেই এ দায় বর্তায় সংশ্লিষ্ট সবার ওপর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘ অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনাই এজন্য দায়ী। আমাদের প্রত্যাশা, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তৎপর হবেন।