শাহ আহমদ রেজা
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩১ এএম
আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জানুয়ারির দুটি ‘ঐতিহাসিক’ দিন

জানুয়ারির দুটি ‘ঐতিহাসিক’ দিন

বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ও অন্যায় ছিল বলেই মুজিব-উত্তর কোনো বছর ২৫ জানুয়ারির মতো ‘ঐতিহাসিক’ একটি দিবসকে আওয়ামী লীগ কখনো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সঙ্গে পালন বা উদযাপন করেনি বরং পার করেছে নীরবে। দিনটির স্মরণে দলটি প্রকাশ্যে কখনো কোনো অনুষ্ঠান করেনি, এমনকি শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কোনো বছর একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি

আজকের নিবন্ধে ইতিহাসের এমন দুটি ঘটনার কথা বলা হবে, যা জানার পর পাঠকরা বুঝতে পারবেন ইতিহাস জানা কেন গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ঘটনা এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত, যার শিকার হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির চেয়ারম্যান এবং স্বাধীন বাংলাদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের চেষ্টায় নিয়োজিত কমিউনিস্ট নেতা সিরাজ সিকদার। এটা ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারির ঘটনা। বাংলাদেশে তখন ‘মুজিবী আমল’ চলছিল। ওই সরকারের কঠোর সমালোচক ও বিরোধী ছিলেন বলে তো বটেই, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন বলেও ১৯৭২ সালেই সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তারের অভিযান শুরু হয়েছিল। সিরাজ সিকদারকে তাই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল। তা ছাড়া কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসেবে এমনিতেই তিনি ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থাকতেন। তাকে এমনকি তার নিজের পার্টির সাধারণ নেতাকর্মীরাও চিনতেন না। সে কারণে তাকে গ্রেপ্তার করাটা সহজ ছিল না। কিন্তু যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করলেও ১৯৭৫ সালের পহেলা জানুয়ারি সিরাজ সিকদার ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের হালিশহরে পার্টির উচ্চপর্যায়ের এক সভার সমাপ্তি টেনে বেরিয়ে এসে বেবিট্যাক্সিতে উঠেছিলেন সিরাজ সিকদার। ওঠার পরমুহূর্তে অচেনা এক ব্যক্তি তার কাছে লিফট চেয়েছিল। প্রথমে অসম্মতি জানালেও উপর্যুপরি অনুরোধে তাকে উঠতে দিয়েছিলেন তিনি। লোকটি বসেছিল চালকের পাশে। চট্টগ্রাম বিপণি বিতানের সামনে আসা মাত্র লোকটি হঠাৎ পিস্তল উঁচিয়ে ধরে এবং বেবিট্যাক্সি থামাতে বাধ্য করে। মুহূর্তে ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকধারী সশস্ত্র গোয়েন্দারা। জীবনের প্রথম ধরা পড়ে যান সিরাজ সিকদার।

গ্রেপ্তার করার পর সিরাজ সিকদারকে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী একটি বিমানে ওঠানো হয় এবং পাইলটের আপত্তি সত্ত্বেও হাতকড়া বাঁধা অবস্থাতেই তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসে নিয়ে প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন চালানোর সময় পুলিশ অফিসাররা তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। সিরাজ সিকদার তার ভাষায় ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের’ কাছে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকাকালেই টেলিফোনে নির্দেশ আসে। তাকে গণভবনে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অপেক্ষা করছিলেন। তার সামনে হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করানো হয় সিরাজ সিকদারকে। বসতে না দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন সিরাজ সিকদার। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করা হয়। এরপর কথা-কাটাকাটি চলে কিছুক্ষণ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে মাথানত করতে অস্বীকার করেন সিরাজ সিকদার। মধ্যরাতে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে আসা হয় সিরাজ সিকদারকে। রাতভর অকথ্য নির্যাতন চলে অনাহারে থাকা এই নেতার ওপর। পরদিন, ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সাভারে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর বিশেষ ঘাঁটিতে। দিনভর সেখানেও চলে নির্যাতন। এক সময় ঢাকা থেকে উপস্থিত হন রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা। বন্দি এবং অর্ধমৃত সিরাজ সিকদারকে দাঁড় করানো হয় সাভার থানার কাছাকাছি তালবাগের এক রাস্তায়। সেখানেই গুলির পর গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে।

পরদিনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় অন্যরকম বিবরণী। ‘সিরাজ সিকদার গ্রেপ্তার : পালাতে গিয়ে নিহত’ শিরোনামে পুলিশের বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ‘জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি (সিরাজ সিকদার) স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি দেন এবং তার দলীয় কর্মীদের কিছু আস্তানা এবং তাদের বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের সঙ্গে যেতেও সম্মত হন। তদনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) রাতে একদল পুলিশ যখন তাকে ভ্যানে করে গোপন আস্তানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি সাভারের কাছে পুলিশের ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। পুলিশ তার পলায়ন রোধের জন্য গুলিবর্ষণ করে। ফলে সিরাজ সিকদারের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।’

প্রতিটি সংবাদপত্রে সেদিন একই ভাষায় একই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে মুখ খুলেছেন অনেকে, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদেরও কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার বিশ্লেষণে পরিষ্কার হয়েছে, সিরাজ সিকদারের মতো একজন কঠোর প্রহরাধীন, হাত-পা বাঁধা এবং মৃতপ্রায় বন্দির পক্ষে চলন্ত পুলিশ ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়া এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার প্রশ্ন উঠতে পারে না। তাকে বরং সুপরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছিল।

দুটি তথ্যের উল্লেখ করলেও এ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। প্রথম তথ্যটি হলো, শেখ মুজিবের ভাগ্নে এবং আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির মালিকানাধীন ও সম্পাদিত দৈনিক বাংলার বাণীতে ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল, ‘বিপ্লব করিবার জন্য চারু মজুমদারকে যে কল্পনা পাইয়া বসিয়াছিল তাহার পরিণতি সকলের জানা থাকিবার কথা। সিরাজ সিকদারের পরিণতি তাহার চাইতে ভিন্নতর কিছু হয় নাই।...’

প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হত্যাকাণ্ডের সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। একদলীয় শাসন তথা বাকশালের প্রতিষ্ঠালগ্নে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের ভাষণে তিনি সিরাজ সিকদার সম্পর্কে দম্ভ ও গর্বের সঙ্গে বক্তব্য রেখেছিলেন। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্ত ও উল্লসিত কণ্ঠে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ সংসদের মতো সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সেই উল্লাস ও আস্ফালন স্তম্ভিত করেছিল সমগ্র জাতিকে। প্রচণ্ড দমনপীড়ন আর হত্যা-সন্ত্রাসের মধ্যে বন্দি জনগণের মনে এ বিশ্বাসই জন্মেছিল যে, সিরাজ সিকদার ‘পালাতে গিয়ে’ নিহত হননি, তাকে আসলে হত্যা করা হয়েছিল এবং হত্যার নির্দেশ এসেছিল সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।

স্মরণ করা দরকার, সিরাজ সিকদার সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন। পূর্ব বাংলার, আজকের বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সিরাজ সিকদার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন দেশের ভেতরে থেকে। ১৯৭১-এর ৩ জুন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি’। জাতীয় ঐক্যের বদলে ভারতের নির্দেশে কলকাতায় গঠিত অস্থায়ী সরকারকে সিরাজ সিকদার ‘পুতুল সরকার’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তা ছাড়া ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় অর্জিত হয়েছিল বলে সিরাজ সিকদার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতে রাজি হননি। তার মতে, স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ‘ভারতের উপনিবেশে’ পরিণত হয়েছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামও ছিল অসমাপ্ত। এই বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্বাধীনতার পরও সর্বহারা পার্টির গেরিলাযুদ্ধ ও সশস্ত্র কর্মকাণ্ড অব্যাহত ছিল।

১৯৭৩-৭৪ সময়কালে সর্বহারা পার্টির কর্মকাণ্ড সর্বাত্মক হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, রাজনৈতিক দমনপীড়ন এবং গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সিরাজ সিকদার দ্রুত একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে নন্দিত হতে থাকেন। তার আহ্বানে ১৯৭৪ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে তিনি এমনকি হরতাল পালনের আহ্বানও জানিয়েছিলেন। জনগণের মধ্যে সে হরতালের আহ্বান অবশ্য সমর্থন পায়নি। তা সত্ত্বেও সিরাজ যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিলেন।

সিরাজ সিকদারের এ অসাধারণ সাফল্য ও জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করেছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। একই কারণে সিরাজ সিকদারকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল বলে রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

এবার জানুয়ারি সম্পর্কিত ইতিহাসের দ্বিতীয় ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট তথা রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে ৬ জুন বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া দেশের সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন।

বাকশাল গঠনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ শেখ মুজিব নাকি ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন এবং বাকশাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল জাতীয় সংসদে। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এসব যুক্তিকে সমর্থন করে না। যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখানো হয় তার জন্য দায়ী ছিল স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, রাজনৈতিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। পরিস্থিতির কারণে দরকার যখন ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যান বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে।

পুরো এ প্রক্রিয়া ও কর্মকাণ্ডের একমাত্র নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ বলা হলেও বাকশাল বাস্তবে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল (বাকশাল বলতে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বোঝানো হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটিকে বাদ দেওয়া হয়নি!)। ‘সাময়িক কালের’ জন্য গঠন করা হয়েছিল ধরনের যুক্তিকেও গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সে ধরনের কোনো বিধান চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং এ কথাই প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় সবক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া থেকে বাকশাল, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা ছিল শুধু শেখ মুজিবের। তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যাকে নির্বাচিত করার কোনো পন্থা, প্রক্রিয়া বা বিধানেরই উল্লেখ ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে। ছিল না সংবিধানেও। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে এ কথাই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান থাকবেন।

এ কথা অবশ্য সত্য যে, চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু অনস্বীকার্য সত্য হলো, ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জনগণকে জানানো হয়নি যে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ এত মৌলিক ধরনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য—যেমনটি পরবর্তীকালে করেছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে পঞ্চম সংসদের সেই অধিবেশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যে অধিবেশনে শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনীকে বাতিল করে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। দ্বাদশ সংশোধনীর অর্থ প্রকৃতপক্ষে ছিল শেখ মুজিবের আরও একটি মৃত্যু। কিন্তু তারপরও সংসদে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমপিরা আনন্দে উল্লসিত হয়েছেন, একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে নৃত্য করেছেন। শেখ হাসিনাও আওয়ামী এমপিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিলেন। টিভি ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের স্টাইলে দুই আঙুলে ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’ বানিয়ে বিজয়ের বার্তা জানিয়েছিলেন জনগণকে। দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনন্দ-উল্লাস স্বাভাবিক হলেও শেখ মুজিবের মনোভাব ও চিন্তাধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কিন্তু মানতেই হবে যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো মুজিববিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার জন্য আওয়ামী লীগের অন্তত এত বেশি উল্লসিত হওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কেননা, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবে শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’কেই প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী এমপিদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন শেখ মুজিবের কোনো চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন!

এটা তাদের পরাজয় বরণ করে নেওয়ার গণতন্ত্রসম্মত কৌশল হতে পারে। কিন্তু এভাবেই তারা একের পর এক মরহুম নেতার ‘কীর্তি’ ও চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করে এসেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বাকশাল, একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজতন্ত্রের মতো মৌলিক বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে প্রত্যাখ্যাত ও পরিত্যক্ত হয়েছে। জনগণকে এমন সময়ও পেরিয়ে আসতে হয়েছে যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কিন্তু বাকশাল প্রতিষ্ঠার ‘ঐতিহাসিক’ দিন ২৫ জানুয়ারিকে নিয়ে সামান্য উচ্চবাচ্য করার সাহস পাননি। দিনটিকে সুকৌশলে পার করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বরং এ কথারই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের পদক্ষেপ ছিল অন্যায়, গণতন্ত্রবিরোধী এবং চরম ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক। পরিবেশও তখন এতটা খোলামেলা ছিল না। পরিস্থিতি বরং ছিল বিশেষ রকমের এবং বদ্ধ ওই সংসদে বিনা বাক্যব্যয়ে নেতা শেখ মুজিবের হুকুম পালন করা ছাড়া কারও কোনো উপায় ছিল না। জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন। একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রতিবাদে দুজনই সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ও অন্যায় ছিল বলেই মুজিব-উত্তর কোনো বছর ২৫ জানুয়ারির মতো ‘ঐতিহাসিক’ একটি দিবসকে আওয়ামী লীগ কখনো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সঙ্গে পালন বা উদযাপন করেনি বরং পার করেছে নীরবে। দিনটির স্মরণে দলটি প্রকাশ্যে কখনো কোনো অনুষ্ঠান করেনি, এমনকি শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কোনো বছর একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। মাঝেমধ্যে দু-চারজন নেতাকে অবশ্য খুবই দুর্বল কণ্ঠে বাকশালের পক্ষে কৈফিয়ত দিতে বা ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ ধরনের যুক্তি তুলে ধরার কসরত করতে দেখা গেছে। কিন্তু কারও পক্ষেই শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’ বাকশালকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। এটা আসলে হওয়ারও কথা নয়। বলা দরকার, শেখ হাসিনার তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৩ সালে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই তিনি সব ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসনব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল। কিন্তু জনগণ বাকশালকে গ্রহণ করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। এজন্যই দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো ২৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

লেখক: সাংবাদিক এবং ইতিহাস গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সারজিস-নাসিরের সঙ্গে কথা বলেছি, এখনো সবাই নিরাপদ : জুনায়েদ

গোপালগঞ্জে ডিসির বাংলোয় হামলা, পুলিশ সদস্য আহত

সারা দেশে ব্লকেড কর্মসূচির ঘোষণা দিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

রাতের মধ্যে ঢাকাসহ ১৯ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

গোপালগঞ্জের ঘটনায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাইলেন রাশেদ

ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যা  / রবিনসহ আরও ৭ আসামি রিমান্ডে

গোপালগঞ্জে ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন 

গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় বিএনপির বিবৃতি

ইসির ওয়েবসাইটে প্রতীকের তালিকায় দাঁড়িপাল্লা

গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউসে এনসিপি কেন্দ্রীয় নেতাদের অবস্থান

১০

রণক্ষেত্র গোপালগঞ্জ, ১৪৪ ধারা জারি

১১

যদি বেঁচে ফিরি তাহলে মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরব : সারজিস 

১২

ঘাস ক্ষেতে পড়ে ছিল শিশুর মরদেহ

১৩

যুদ্ধ নয়, শান্তি ও দেশ গড়ার আহ্বান জানাতে গোপালগঞ্জ এসেছি : নাহিদ ইসলাম

১৪

আবু সাঈদের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিল ‘বিচার রাজপথেই হবে’

১৫

সাভারে কিশোরীকে গণধর্ষণের পর হত্যা, কিশোর গ্রেপ্তার

১৬

সারা দেশের মানুষকে গোপালগঞ্জে ডাকলেন সারজিস

১৭

গোপালগঞ্জে সমাবেশ শেষে এনসিপির পদযাত্রায় হামলা

১৮

বাংলাকে স্বৈরাচার মুক্ত করতে বুলেটে জীবন যায় ওয়াসিমের

১৯

নতুন কোচ পেলেন হামজারা

২০
X