দৈনিক কালবেলায় গত ৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘বিএনপি-জামায়াত বাহাস দ্বন্দ্ব নাকি মতবিরোধ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি সচেতন ব্যক্তিদের চিন্তার নতুন খোরাক জুগিয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান দ্বান্দ্বিক অবস্থানের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরার আশঙ্কা করছেন অনেকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিসম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিস্ফোরক মন্তব্যে রাজনীতিতে নতুনভাবে উত্তেজনা এবং মানুষের মনে কৌতূহল দেখা দিয়েছে। কালবেলা লিখেছে, আওয়ামী লীগের পতন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর দল দুটির মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের কয়েকজন নেতা কালবেলাকে বলেছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ভেতরে ভেতরে সযোগিতা করছে। তারা নির্বাচনী জোট করে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার প্রচেষ্টায় রয়েছে। মিত্রদের পাশাপাশি বিএনপিও এ ধারণা করছে। ফলে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী নেতারা বাগযুদ্ধে জড়িয়েছেন।’
এই বাগযুদ্ধের সূচনা করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেওয়া তার ‘বাক্যগোলা’ দীর্ঘদিনের ‘জান-পেহচান’ দুই দলের সম্পর্কের দেয়ালে বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি করেছে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এ দুই দলের মধ্যে নানা বিষয়ে শীতল যুদ্ধ চলছিল। মূলত অন্তর্বর্তী সরকারকে রাষ্ট্র সংস্কার ও পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার বিষয়ে তাদের মতপার্থক্য অপ্রকাশ্য থাকেনি। বিএনপি সংস্কার অসম্পন্ন রেখেই ‘দ্রুত নির্বাচন’ দাবি করলেও তাদের এক সময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী পূর্ণ সংস্কার শেষে নির্বাচনের পক্ষে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে আসছিল। এই মতভেদ সত্ত্বেও দুই দলের মধ্যে সরাসরি কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জামায়াত প্রশ্নে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কোনো কোনো নেতার কথাবার্তায় দল দুটির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটার আলামত লক্ষ করা যায়। এমনি সময়ে বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদ সরাসরি জামায়াতে ইসলামীকে আক্রমণ করে বক্তব্য রেখে তুষের আগুন অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করেছেন।
গত ২৯ ডিসেম্বর একটি শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। রিজভী বলেছেন, ‘দুয়েকজন উপদেষ্টা সবক দেন, দু-একটি রাজনৈতিক দল দেখি তারাও সবক দেয় যে, চাঁদাবাজ বিদায় নিয়েছে আর কোনো চাঁদাবাজকে আমরা দেখতে চাই না। কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন? শেখ হাসিনার আমলে যারা ব্যাংক লুট করেছে, ব্যাংক আত্মসাৎ করেছে—এস আলমের উত্তরসূরি হিসেবে ৫ আগস্টের পর আমরা কি ব্যাংক আত্মসাৎ করতে দেখিনি? আমরা তো দেখেছি ইসলামী ব্যাংক কীভাবে গ্রাস করে নিল একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা।’ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আজ কোন মুখে বলছেন, এক চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেক চাঁদাবাজকে দেখতে চায় না। কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, আমরা বুঝি না? আমরা তো প্রথমেই দেখলাম, ৫ আগস্টের পরদিনই ইসলামী ব্যাংক আপনারা দখল করেছেন, এটা জনগণ দেখেনি?’ দু-একটি রাজনৈতিক দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায় অভিযোগ করে রিজভী আরও বলেছেন, ‘জনগণের প্রতি অঙ্গীকার থেকে বিএনপি কখনো পিছিয়ে আসেনি। ১৯৭১ থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিএনপি কখনো মাথানত করেনি।’ (সূত্র: কালবেলা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪)
বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদের বক্তব্যে অসংলগ্নতা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘১৯৭১ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট (২০২৪ সাল) পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রশ্ন বিএনপি কখনো মাথানত করেনি।’ অথচ বিএনপির জন্মই হয়েছে একাত্তরের সাত বছর পর ১৯৭৮ সালে। আবেগ-উত্তেজনা অনেক সময় বক্তার স্মৃতিভ্রম ঘটায়। এজন্য বিজ্ঞজনরা বক্তব্য রাখার সময় আবেগ-উত্তেজনা যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ওইদিন রিজভী আহমেদ কতটা উত্তেজিত বা আবেগাক্রান্ত ছিলেন বলা মুশকিল। তবে জামায়াতে ইসলামীকে একহাত নিতে গিয়ে তিনি যে নিজেদের ‘আত্মস্বীকৃত’ চাঁদাবাজে পরিণত করেছেন, বোধকরি তা খেয়াল করেননি। কেননা, ৫ আগস্টের পর জামায়াতে ইসলামী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা ‘এক স্বৈরাচার-চাঁদাবাজ হটিয়ে আরেক স্বৈরাচার ক্ষমতায় বসাব না’ বললেও বিএনপি বা কোনো রাজনৈতিক দলের নামোল্লেখ করেননি। তাহলে রিজভী আহমেদের কেন মনে হলো কথাগুলো বিএনপিকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে? তার এমনতর বক্তব্যে ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদবাক্য মনে পড়া অসংগত নয়। কেননা, ৫ আগস্টের পর গত পাঁচ মাসে দেশজুড়ে দখল ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় থেকে ইউনিয়ন লেভেল পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে জামায়াতের নেতাকর্মীদর বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অবশ্য প্রচারিত আছে, সরকারি প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে কৌশলে নিজেদের লোক বসিয়েছে জামায়াত। এ ক্ষেত্রে বিএনপি অনেক পিছিয়ে। তবে দুয়েকটি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদে বিএনপি ঘরানার ব্যক্তিরা বসতে পেরেছেন।
এদিকে রিজভীর বক্তব্যের জবাবে ওইদিনই জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি রিজভীর বক্তব্যকে বিভ্রান্তিকর, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘রিজভী জামায়াতের বিরুদ্ধে এসব কথা বলে কী অর্জন করতে চান, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। জামায়াত রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতি কখনো করেনি।’ (কালবেলা, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪)
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুই প্রধান দলের এ বাগযুদ্ধকে আগামী দিনের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত মনে করছেন সচেতন ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতের বন্ধুত্ব অত্যন্ত গুরুত্ববহ। পরীক্ষিত সত্যি হলো, বিএনপি-জামায়াত ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে অন্য কোনো দল বা জোটের তাদের সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ঐক্য না হলেও বেশ কিছু আসনে সমঝোতা হয়েছিল। সে নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ১৪৬টি আসন আর জামায়াতে ইসলামী পেয়েছিল ১৮টি। সরকার গঠনের সময় জামায়াত বিএনপিকে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়। এর বিনিময়ে বিএনপি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জামায়াতকে দুটি সংরক্ষিত মহিলা আসন উপহার দেয়। কিন্তু ১৯৯৫-৯৬ সময়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ‘সংসদের বিরোধী দল’ হিসেবে তাদের সখ্য হয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে। সে সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে পাশাপাশি বসে মিটিং করতে দেখা গেছে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে মাত্র তিনটি আসন পায়। আর সে নির্বাচনে বিএনপি পায় ১১৬টি আসন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ওই নির্বাচনে বিএনপি ৫০টিরও বেশি আসনে পরাজিত হয়েছিল ২ হাজার ৯০০ থেকে ৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে। ওইসব আসনে জামায়াতে প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫ থেকে ১০ হাজার। ধারণা করা হয়, ১৯৯৬-এর নির্বাচনেও যদি বিএনপি-জামায়াত সমঝোতা করত, তাহলে বিএনপিই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত। ১৯৯৬-এর শিক্ষাকে মাথায় রেখে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে মনোনিবেশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে শরিক দল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় জামায়াত। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী পায় ১৭টি আসন। সে সুবাদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (পরবর্তী সময়ে উভয়ে ফাঁসিতে নিহত) মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনার নিরিখে এটা বলা যায় যে, আওয়ামী লীগের বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত জোট ছিল শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। যেজন্য আওয়ামী লীগ সবসময় চেষ্টা করেছে এ দুই দলের বন্ধুত্ব ভেঙে দিতে।
বিএনপির ওপর জামায়াতে ইসলামী অসন্তুষ্ট হয় ২০১৩ সালে হাসিনা সরকার যখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দলটির শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে মৃত্যুদণ্ড-আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। জামায়াতের অভিযোগ, বিএনপি সে সময় দলটির পাশে দাঁড়ায়নি। জামায়াতের অভিযোগ অসত্য না হলেও ওই পরিস্থিতিতে ‘যুদ্ধাপরাধের মামলায়’ দণ্ডিতদের পক্ষে সরাসরি দাঁড়ানো বিএনপির পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেননা বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির সরাসরি ‘স্বাধীনতাবিরোধী’দের পক্ষালম্বন নতুন প্রশ্নের জন্ম দিত। তাই তারা এ বিষয়ে ‘নীরবতাই শ্রেয়’ মনে করে থাকবে। তারপরও ২০২২ সাল পর্যন্ত ঢিলেঢালা হলেও বিএনপি-জামায়াতের সখ্য অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে দুই দল অবস্থান নিয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে।
এদিকে রিজভী আহমেদরা জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিলেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনো ঐক্যের কথাই বলছেন। তিনি বারবার বলেছেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলে তারা হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবেন। তারেক রহমানের বক্তব্যকে তার আন্তরিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ধরে নিলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে রিজভীসহ অন্য নেতাদের হঠাৎ জামায়াতবিরোধী বক্তব্যের কারণ কী? তারেক রহমানের পূর্বানুমতি ছাড়াই কি তারা এ অবস্থান নিয়েছেন? তাদের এ অবস্থান তারেক রহমানের ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে কি না। অন্যদিকে নির্বাচন না আসতেই বিএনপি-জামায়াত যেরকম বাগযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, তাতে ৫ আগস্টের অর্জন বিপন্ন হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেছেন কেউ কেউ। এ বাগবিতণ্ডা লীগবিরোধী শিবিরে বিভক্তি অনিবার্য করে তুলতে পারে; যা পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তির পুনরুত্থানের সুযোগ করে দেবে। রাজনীতি-সচেতন মহল তাই বাগযুদ্ধের ইতি টেনে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের অর্জন সুরক্ষায় উভয় দলের যত্নবান হওয়া উচিত বলে মনে করছেন। কেননা, ইতিহাস বলে, বিজয়ী শক্তির বিভেদ সবসময় পরাজিত শক্তিকে মাঠে নামার সুযোগ করে দেয়।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক