ড. মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৫০ এএম
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

শরিয়াহ বোর্ডের ভূমিকা কতটুকু

শরিয়াহ বোর্ডের ভূমিকা কতটুকু

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ‘ব্যাংকস হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ১০টি ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে আটটি অর্থাৎ, ৮০ শতাংশ ইসলামিক ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের তালিকায় অন্তৰ্ভুক্ত। দুর্বল ব্যাংকগুলো হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, আল-আরাফাহ, স্ট্যান্ডার্ড, ইউনিয়ন, এক্সিম এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে এতটাই দুর্বল যে, আমানতকারীদের আন্দোলন করতে হয়, ব্যাংক ব্রাঞ্চ বন্ধ করে দিতে হয় শুধু নিজেদের গচ্ছিত টাকা উত্তোলনের জন্য। অনেক ইসলামী ব্যাংক একদিনে একজন গ্রাহককে ৫০ হাজার টাকাও উত্তোলনের সুযোগ দেয় না। গ্রাহকরা এতে চিন্তিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত, যা তাদের ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। তারল্য সংকটে ইসলামী ব্যাংকগুলো জর্জরিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় এ ব্যাংকগুলো টিকে থাকার সংগ্রাম করছে।

ইসলামিক ব্যাংকিং নীতি অনুযায়ী অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং শরিয়াহ অনুমিত উৎপাদনশীল খাতে ইসলামিক ব্যাংকগুলো শুধু বিনিয়োগ করতে পারে। যেই বিনিয়োগে রিটার্ন অনিশ্চিত বা কাল্পনিক রিটার্ন থাকে, অতিরিক্ত ঝুঁকি থাকে, গ্যাম্বলিংয়ের সম্ভাবনা থাকে এবং মানুষের অকল্যাণ হয় (যেমন তামাক, প্রাণঘাতী অস্ত্র), তা শরিয়াহ অনুমতি দেয় না। অর্থাৎ একটি ইসলামিক ব্যাংককে শরিয়াহ নির্ধারিত একটি সীমারেখার মধ্যে মানবকল্যাণ সাধনে তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত করতে হয়। এ অবস্থায় কোনো ইসলামিক ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ার কথা নয় কিংবা তারল্য সংকটে পড়ার কথা নয় কিংবা দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেন তা হচ্ছে বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোতে? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক কারণ আসতে পারে, তবে মোটা দাগে একটা কারণ স্পষ্ট যে, শরিয়াহ গাইডেন্স অনুযায়ী এ ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণ পরিচালিত হতে পারছে না। শরিয়াহ গাইডেন্স খুবই স্পষ্ট এবং নির্ধারিত, সমস্যা হচ্ছে এগুলো বাস্তবে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা।

ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের একজন বিশেষজ্ঞ গবেষক হিসেবে, ইসলামিক ব্যাংকের ঝুঁকি, এফিসিয়েন্সি, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি এবং শরিয়াহ গভর্ন্যান্স নিয়ে আমার গবেষণা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১০টিরও বেশি টপ ফাইন্যান্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের এফিসিয়েন্সি এবং শরিয়াহ গভর্ন্যান্স নিয়ে আমার পিএইচডি গবেষণাই ২০১৯ সালে সর্বপ্রথম Journal of Corporate Finance (ABDC A*/ABS-4 ranked)-এর মতো উচ্চমানের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।

বিশ্বের ২৮টি দেশের ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে আমার গবেষণায় দেখা যায়, যেসব ইসলামিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং শরিয়াহ বোর্ড বা শরিয়াহ কমিটি দুর্বল, সেই ইসলামিক ব্যাংকগুলোতে রিস্ক বেশি, কস্ট অ্যান্ড প্রফিট এফিসিয়েন্সি কম, পারফরম্যান্স দুর্বল এবং ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি কম। বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলো আর্থিকভাবে এবং শরিয়াহ পালনে দুর্বল কারণ তাদের পরিচালনা পর্ষদ ও শরিয়াহ বোর্ড বা শরিয়াহ কমিটি দুর্বল। পরিচালনা পর্ষদের সামগ্রিক দায় থাকলেও, শরিয়াহ পরিপালন নিশ্চিত করা শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদেরই দায়িত্ব। পরিচালনা পর্ষদের জবাবদিহি থাকে শেয়ারহোল্ডারদের কাছে, কিন্তু শরিয়াহ বোর্ডের জবাবদিহির জায়গাটা অস্পষ্ট।

আমার বিশদ গবেষণায় দেখা যায়—১. বড় আকারের শরিয়াহ বোর্ড; ২. শরিয়াহ বোর্ড মেম্বারদের যারা একসঙ্গে অনেক ইসলামিক ব্যাংক বা ফাইন্যান্স বা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শরিয়াহ বোর্ড মেম্বার; ৩. যাদের মেইনস্ট্রিম ফাইন্যান্স, ব্যাংকিং, অ্যাকাউন্টিং বা ইসলামিক বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে পিএইচডি, গবেষণা এবং উন্নতমানের পাবলিকেশনের অভিজ্ঞতা নেই, তাদের মাধ্যমে গঠিত ইসলামিক ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ড খুবই দুর্বল হয় এবং যার ফলে ইসলামিক ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে দুর্বল হয় এবং বাস্তবিকপক্ষে শরিয়াহ বিধিবিধান পালনে কম সচেষ্ট হয়। বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ড নিয়ে গবেষণা করে পাওয়া যায় যে, শরিয়াহ বোর্ডের এ তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যমান। অধিকন্তু ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক বিবেচনায়ও শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য নিয়োগ হয়, যারা সাহস নিয়ে শরিয়াহ নন-কম্পিলিয়ান্স হতে দেখলেও ভূমিকা না রেখে নীরব থাকেন। ইসলামিক ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।

ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসতে শরিয়াহ গাইডেন্স পরিপূর্ণভাবে পালন কীভাবে করা যায় সেই লক্ষ্যে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করা খুবই দরকার। এ ক্ষেত্রে শরিয়াহ বোর্ডের গভর্ন্যান্স সম্পর্কিত ওপরের তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ বোর্ডগুলো পুনর্গঠন করে, শরিয়াহ বোর্ড সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্র তৈরি করা হবে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। একটি দক্ষ এবং দায়বদ্ধ শরিয়াহ বোর্ডই পারে একটি ইসলামিক ব্যাংকের পথচলায় মূল ভূমিকা পালন করতে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, RMIT ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এক যুগ পর বাড়ি ফিরলেন ওমান ফেরত মানসিক ভারসাম্যহীন সুমন

এইডস রোগীদের বাঁচাতে টিকা আনছে রাশিয়া

বিদেশি শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের মার্কিন ভিসা নিয়ে দুঃসংবাদ

পরিচালক নয়, সভাপতি হয়েই বিসিবিতে ফিরতে চান তামিম

তিশাকে কোলে তুলতে গিয়ে হাত ভেঙেছিল: তৌসিফ মাহবুব

ডিআরইউতে লতিফ সিদ্দিকীসহ আ.লীগের নেতাকর্মী অবরুদ্ধ

আগারগাঁও মোড়ে শিক্ষার্থীদের ব্লকেড, যান চলাচল বন্ধ

আবাসিক হোটেল থেকে পুরুষ সঙ্গীসহ টিকটকার মাহি আটক

১২ ফুট লম্বা অজগর বস্তায় করে বাড়িতে নিয়ে গেল যুবক

কত সম্পদের মালিক টেইলর-কেলসে?

১০

৪ কারণে ভেঙে দুই ভাগ হয়েছিল চট্টগ্রামের সেতুটি

১১

পুলিশের পোশাকে থানায় গুরুদায়িত্বে বিড়াল!

১২

নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের পরও দলকে জেতাতে পারলেন না সাকিব

১৩

দলকে ফাইনালে তুলে যা বললেন মেসি

১৪

চাকরি দিচ্ছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, থাকছে না বয়সসীমা

১৫

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ উত্তেজিত জনতার

১৬

আবু সাইদ হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ আজ

১৭

কেন নিজের ‘বিকিনি’ ছবির পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেন শর্মিলা?

১৮

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ৪ প্রতিনিধি যোগ দিলেন ছাত্রদলে

১৯

ধীরে ধীরে খেলে কি সত্যি ওজন কমে?

২০
X