‘আমার একজন সাংবাদিক দরকার।’—লোকটা ফোনে কাকে যেন এ কথা বললেন। সেদিন ছুটি নিয়ে আমি বাড়িতে যাচ্ছিলাম। চালকের পেছনেই আমরা বসা। ঢাকা থেকে বাস ছাড়ার পর থেকে তিনি ফোনে নানা কথা বলছেন। যাত্রাবিরতি শেষে বাসটি বগুড়া পার হলো। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘প্রতি সপ্তাহে আর বাড়ি যেতে ভালো লাগে না। জমি থাকা যে কী ঝামেলা। আমাদের জমি একজন দখল করে নিচ্ছে। সে আওয়ামী লীগ করে। পুলিশ-চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউ আমার কোনো কথা শোনে না।’
এটি জুলাই অভ্যুত্থানের আগের ঘটনা। বুঝলাম লোকটা সমস্যায় পড়ে সাংবাদিক খুঁজছেন। তার আর অন্য কোনো পথ নেই। তার ধারণা, সাংবাদিক তাকে উদ্ধার করতে পারবেন। শুধু কি তিনি, কত সমস্যায়, কত প্রান্তিক মানুষ সাংবাদিক খোঁজেন, কিন্তু সাংবাদিকের নাগাল পান কি?
সাংবাদিক অর্থাৎ গণমাধ্যমকর্মী। তার কাজই হলো খবর যথাযথভাবে সংগ্রহ করা। আর গণমাধ্যম খবর বাছাই করে প্রকাশ করে। ডি ফ্লার ও বল রোকেশের গণমাধ্যম নির্ভরতা তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ বাস্তব জীবন থেকে যা অর্জন করে, তা যথেষ্ট নয়। আরও জানার জন্য অর্থাৎ আরও তথ্যের জন্য তাকে গণমাধ্যম ব্যবহার করতে হয়।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের যাত্রা সহজ নয়। ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে ‘স্টিম ইঞ্জিন’ চালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর গণমাধ্যমের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা রূপ নেয় চরম হতাশায়। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সরকার বাকশাল গঠনের নামে চারটি পত্রিকা বাদে বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়। এরপর আসে সামরিক শাসন ও গণঅভ্যুত্থান। ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। বইতে শুরু করে গণতন্ত্রের সুবাতাস। সংশোধন করা হয় ‘প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট-৭৩’। দেশে তখন ‘প্রেস বুম’ ঘটে। এরপর গণমাধ্যমের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারগুলোর কাছে মালিকদের দলীয় পরিচয় প্রাধান্য পেয়েছে। সাধারণদের চোখে গণমাধ্যম হয়তো খুব শক্তিশালী। কিন্তু এই শক্তি নির্ভর করে গণমাধ্যমের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
গণমাধ্যম যে খবর প্রকাশ করে তা পরিশোধনের মাধ্যমে করে। সংবাদ বাছাই বা পরিশোধের এ কাজটি করেন মূলত সম্পাদক ও অন্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের নিজস্ব নীতিমালা, চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠী, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করা হয়।
তাহলে গণমাধ্যম কি আসলে গণমানুষের হতে পারে? প্রতিদিন কত ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমে সবটা আসে না। যদি বলি একটা গরু মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সাংবাদিক গিয়ে টাকা খেয়েছে, অবিশ্বাস হবে? গণমাধ্যম বা এর কর্মী কি সাধারণ মানুষের কথা শোনে? ধরে নিচ্ছি, না। তাহলে গণমাধ্যম কী করছে, কাদের কথা শুনছে? নিশ্চয়ই কিছুসংখ্যক মানুষের?
গণমাধ্যম কেন কিছুসংখ্যক মানুষের হলো; এর কারণ খুঁজতে গণমাধ্যমের অন্দরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সহজ হিসাবে প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যম মূলত টিকে থাকে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। আবার গণমাধ্যম যাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, তাদের প্রভাব কতটুকু সেটিও বিবেচ্য। গণমাধ্যমের এখন আলাদা ক্লাস তৈরি হয়েছে। সাধারণ, উচ্চশিক্ষিত, এলিট, ব্যবসায়ী ও দলের বিবেচনায় বাজারে আলাদা আলাদা পত্রিকা রয়েছে। গণমাধ্যম কি গ্রাম ও শহরকে এক করে দেখে? যদি তারা সাধারণ, স্বল্পশিক্ষিত ও খেটে খাওয়া মানুষকে এড়িয়ে চলে, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা কোথায়? টেলিভিশনেও এখন সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। তারা কি তাহলে খবর দেখে না? অবশ্যই দেখে। গণমাধ্যমে জায়গা না পেয়ে তারা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেছে নিয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমের প্রভাব কমে আসার এটি একটি বড় কারণ।
সরকারও এখন মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপারে বেশি উদ্বেগে থাকে। এই যে বেক্সিমকো গ্রুপের কত কোটি টাকা ঋণ, সামিটের আজিজ খান কোথায় নাগরিকত্ব নিলেন বা এস আলম কত কোটি টাকা লুট করলেন—আমাদের গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর বিরাট জায়গা পাচ্ছে। আবার সরকারের ঋণ কত, ব্যাংকে ডলার সংকট, এনবিআরের রাজস্ব আহরণ, বাজেটে ঘাটতি, দুদকের তদন্ত বা ব্যাংকের ঋণখেলাপির খবরে একজন সাধারণ মানুষের কী যায় আসে। গোষ্ঠী বা দলভিত্তিক গণমাধ্যমে আমাদের কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি বা বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত নিয়ে চর্চা নেই। এটাই বাস্তব যে, গণমাধ্যমগুলো সরকার বা রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট করতে ব্যস্ত। অথচ এর বাইরে সামাজিক অনেক বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে আওয়াজ নেই। হলেও খুব কম।
রাষ্ট্র ও সমাজকে গণমাধ্যম ভিন্ন চোখে দেখছে। রাজনীতিতে গণমাধ্যমের যতটা আগ্রহ, সাধারণ মানুষের ততটা নেই। দেশে খুব কম মানুষই আদর্শিক জায়গা থেকে রাজনীতি করে। বেশিরভাগই করে পেটনীতি থেকে। অর্থাৎ যে দল ক্ষমতায় থাকবে, সে দলে ঘেঁষে সুবিধা নেওয়া। মফস্বলে একটা ভাতার কার্ড পেতেও রাজনৈতিক সমর্থক হওয়া লাগে। গণমাধ্যম গ্রামের কথা উঠে আসছে না। শহরে আর কত মানুষ থাকে। আমাদের মেগা উন্নয়নে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে মাইক্রো করে রেখেছি। শহরের ছোট ঘটনা গণমাধ্যম যত গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরে, গ্রামের একটা বড় ঘটনাও মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। আমাদের গ্রাম যে এগিয়ে যাচ্ছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ যে বিদেশের শ্রমবাজারে রয়েছে, গণমাধ্যমে তেমন আসে না।
সচিবালয়ে সাংবাদিক ঢুকতে পারবে কি না, পুলিশের পোশাকের রং পরিবর্তন বা যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিসভা থেকে শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপের পদত্যাগের খবরে আমাদের গণমাধ্যমগুলো খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অথচ আমাদের কৃষকদের উৎপাদন ক্ষমতা, কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের গল্পে তাদের আগ্রহ নেই। গ্রামের সংবাদ হয়ে গেছে থানা, ইউএনও ও ডিসি কার্যালয়নির্ভর। চারদিকে এখন বক্তব্য আর মন্তব্যনির্ভর খবরের ছড়াছড়ি। কোনো অনুসন্ধান নেই, ফলোআপ নেই। গ্রামের স্কুলগুলোতে কেমন পড়াশোনা চলছে, হাসপাতালগুলোর কী অবস্থা, পরিবহনব্যবস্থা কেমন—এসব বিষয়ে গণমাধ্যমের আগ্রহ নেই। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী গবেষণা হচ্ছে, গবেষকরা কী করছেন, সে খবর নেই।
আমাদের গণমাধ্যমে মধ্যবিত্তদের গল্প নেই, স্থানীয় অর্থনীতি নেই। মানুষকে দ্রব্যমূল্যের খবর জানতে হয় বাজার থেকে। অযাচিতভাবে কোনো পণ্যের দাম বাড়লেও গণমাধ্যমের মাথাব্যথা নেই। আবার শহরের মধ্যবিত্তরা যতটুকু মিডিয়া কাভারেজ পান, গ্রামের মধ্যবিত্তরা তাও পান না। সামাজিক সুরক্ষা ও উন্নয়ন কর্মসূচি, অনিয়ন্ত্রিত বাজার, সরকারি সেবাবঞ্চিত সাধারণ মানুষের স্থান গণমাধ্যমে সংকীর্ণ।
গণমাধ্যম কীভাবে এবং কেন কাজ করে তা ‘প্রোপাগান্ডা মডেলে’ দেখিয়েছেন এস হারমেন ও নোয়াম চমস্কি। এ মডেলে তারা দেখিয়েছেন, কীভাবে গণমাধ্যম কাঠামোগতভাবে নির্দিষ্ট স্বার্থের অধীন হয়ে ওঠে। তাদের মতে, পাঁচটি ফিল্টার গণমাধ্যমকে প্রভাবিত করে। প্রথমত, গণমাধ্যমের মালিকানা। সাধারণত বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গণমাধ্যমের মালিক হয় এবং নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষার জন্য খবর নিয়ন্ত্রণ করে। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞাপনদাতা। বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমের আয়ের প্রধান উৎস। ফলে বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থবিরোধী খবর পরিবেশন করা হয় না। তৃতীয়ত, খবরের সূত্র। গণমাধ্যম নির্দিষ্ট কিছু সরকারি, করপোরেট বা জনসংযোগসূত্রের ওপর নির্ভরশীল, যা বারবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। চতুর্থত, ফ্লাক বা প্রতিবন্ধকতা। এটি হুমকি, মামলা বা বিজ্ঞাপন প্রত্যাহারের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে নিরপেক্ষতা থেকে বিরত রাখে। পঞ্চমত, অ্যান্টি-কমিউনিজম বা অ্যান্টি-টেররিজম। রাজনৈতিক বা আদর্শিক প্রতিপক্ষকে দমন করতে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে জনমত প্রভাবিত করা হয়।
দেশে কয়েক দিন পরপর ধান্দা নিয়ে নতুন নতুন গণমাধ্যম আসে আর সংকটে পড়ে। টিকে থাকলেও কোনো প্রভাব নেই। কারণ কনটেন্ট, তথ্যের জোগান। যে গণমাধ্যম যত বেশি তথ্যের চাহিদা মেটাতে পারে, জনগণ সে গণমাধ্যমের প্রতি তত নির্ভরশীল হয়। আর সে গণমাধ্যম হয়ে ওঠে তত প্রভাবশালী। গণমাধ্যমের অডিয়েন্সই হলো তার রেভিনিউ বা ব্যবসায়িক শক্তি। নিউ মিডিয়ার যুগে গণমাধ্যমের পক্ষে অডিয়েন্স তৈরি এবং ধরে রাখা সহজ নয়। এজন্য প্রয়োজন বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও যথাযথ বাস্তবায়ন।
এখন যারা আছে বা আসছে, তাদের উদ্দেশ্য ব্যবসা। তারাও এই প্রোপাগান্ডা মডেলের আবর্তে রয়েছে। সাংবাদিকতার মানদণ্ড না মেনে, স্বার্থগত কারণে অনেক গণমাধ্যম এই ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি করেছে। কারণ তারা শুধু মাধ্যম হতে পেরেছে, ‘গণ’ মাধ্যম হতে পারেনি।
লেখক: গণমাধ্যম বিশ্লেষক