নদীর দেশ আছে। নদীর চলার শেষও আছে। নদীর উৎপত্তি হয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে সাগরে পতিত হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু নদীর এ চলার পথ থামিয়ে দেয় মানুষ। মাঝপথেই নদী থেমে যায়। থেমে যেতে বাধ্য হতে হয়। আর সে থেমে যাওয়ার দায় মানুষের। আমরা নদীকে গলা টিপে হত্যা করছি। শোষণ করছি, শাসন করছি। দূষণ করছি। দখল করছি। অধিক মুনাফার জন্য কলকারখানার বর্জ্য নদীর পানিতে ঢেলছি। আমাদের সত্যি কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ নেই। যে নদী আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই নদীকে আমরা খুন করছি প্রতিনিয়ত, অকৃতজ্ঞের মতো।
পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আদিম মানুষ নদীর তীরে বসবাস করত তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধাজনক বলে। এজন্য প্রাচীনকালে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে। পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উদ্ভব ঘটে পানিতে, আবার প্রাচীন সভ্যতাগুলোরও বিকাশ ঘটে পানির কাছাকাছি; অর্থাৎ নদীর তীরে। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতাগুলোকে বলা হয় ‘নদীমাতৃক সভ্যতা’।
আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে নদীমাতৃক সভ্যতাগুলোর বিকাশ শুরু হয়। প্রাচীন বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সভ্যতাগুলোর অধিকাংশ বিভিন্ন নদী অববাহিকা অঞ্চলে গড়ে ওঠে। এগুলোর মধ্যে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে ওঠে মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলনীয় ও সুমেরীয় সভ্যতা। টাইগ্রিস নদীর তীরে অ্যাসিরীয় ও টাইবার নদী তীরে রোমান সভ্যতা। নীল নদের তীরে মিশরীয় এবং বাদুর নদীর তীরে রংপুর সভ্যতা। রাভী নদীর তীরে হরপ্পা আবার রাইন নদীর তীরে সেলটিক/কেলটিক সভ্যতা। সিন্ধু নদের তীরে মহেঞ্জোদারো সভ্যতা। ভূমধ্যসাগরের তীরে ইজিয়ান সভ্যতা ও ইয়াং-সি কিয়াং এবং হোয়াংহো নদী তীরে চৈনিক সভ্যতা প্রভৃতি অন্যতম।
নদীমাতৃক সভ্যতা গড়ে ওঠার কারণগুলো ছিল—উর্বর কৃষিজমি, পানি সেচের সুবিধা, পশুপালনের সুবিধা, পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতের সুবিধা, মাছ শিকার, অধিক নিরাপত্তা, অনুকূল আবহাওয়া, পানীয় জলের সুবিধা ইত্যাদি। বর্তমানে এ সুযোগ-সুবিধা অটুট আছে। আজও কৃষিজমিতে সেচের জন্য পানি লাগে, মাছ শিকার করতে, যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে অধিক সুবিধা পাওয়া নদীপথ থেকে।
একটি দেশের প্রাণ হলো নদী। প্রাণ-প্রকৃতির রসদ জোগায় নদী। মানুষের শরীরে যেমন রক্ত প্রবাহ না থাকলে প্রাণের স্পন্দন থাকে না, তেমনি কোনো দেশে নদী না থাকলে সে দেশকে একরকম মৃতই বলা যায়। সভ্যতা ভূলুণ্ঠিত হয়। প্রাণ-প্রকৃতি জীবন্মৃত হয়ে যায়।
বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। কেননা এ দেশে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নদনদী। শহর-গ্রাম সবখানে। নদীই এ দেশের প্রাণ। নদী আছে বলেই এ দেশের প্রকৃতি এত সুন্দর, মানুষের মন এত কোমল। কিন্তু দিন দিন আমরা নদীহীন হয়ে পড়ছি। ১ হাজার ২০০ নদীর দেশে আজ নদী সংখ্যা কত— তা নিয়ে বিতর্ক আছে। যে নদীগুলো বেঁচে আছে সে নদীগুলোর অবস্থাইবা কী?
না, দেশের নদীগুলো ভালো নেই। হাতেগোনা কয়েকটি নদী ছাড়া গ্রীষ্মে নদীগুলো প্রাণহীন হয়ে পড়ে। কৃষক সেচের জন্য পানি পান না। খেতের মাঝখানে গর্ত করে তারপরও পানি পাওয়া যায় না।
নদনদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে পানির স্তরও নেমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচণ্ড দাবদাহ, বৃষ্টি না হওয়া, শহরের বেশিরভাগ পুকুর ও জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ ও অপরিকল্পিত সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে ক্রমেই নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। পানি সংকটের বড় শিকার বরেন্দ্র অঞ্চল। গবেষণার তথ্যমতে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সেসময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নামে ৬৮ ফুট। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির গড় ছিল ৫০ ফুট। ২০২১ সালে ভূগর্ভস্থ পানির গড় আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। দিন দিন বরেন্দ্র অঞ্চলে যে মরূকরণ শুরু হয়েছে, তা ভবিতব্যই বলে দেবে।
পানির স্তর নেমে যাওয়ার পাশাপাশি নদীর পানিতে বাড়ছে লবণাক্ততা। ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। জোয়ার-ভাটার তারতম্যের কারণে সমুদ্রে জোয়ারের সময় উপকূলীয় ২২ জেলার নদীতে ছড়িয়ে পড়ত সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি। মধুমতী, পায়রা, কর্ণফুলী, মেঘনা, কীর্তনখোলা, হালদাসহ বিভিন্ন নদীতে লবণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ুর প্রভাবে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি ছাড়িয়ে পড়ছে। মিঠাপানিতে লবণাক্ততার প্রভাব বেড়ে গেলে মৎস্য ও কৃষিসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
দেশের ৩৫ হাজার কিলোমিটার নদীপথের এখন মাত্র ২২ হাজার কিলোমিটার টিকে আছে। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে এ পথ বিলীন হতে খুব বেশি দিন সময় লাগবে না। হাতেগোনা মানুষের স্বার্থের কারণে নদী ও পরিবেশ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ব-দ্বীপ অঞ্চলের নদী হিসেবে আমাদের নদীগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত শাখা নদী, খাল, প্লাবন অঞ্চল ও জলাশয়গুলো বিলীন হতে চলেছে। নদী ও জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠছে। দেশে বর্তমানে এক হাজার আটটি নদনদী রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। তারা দেশে নদনদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি উল্লেখ করে।
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, দিন দিন নদীর সংখ্যা কমছে এটাই বাস্তবতা। নদীপথের দৈর্ঘ্যও কমছে। নদীগুলো ভালো নেই। তাই নদী বাঁচাতে বাংলাদেশে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করেন। রায়ে হাইকোর্ট তুরাগ নদকে লিগ্যাল পারসন (আইনগত ব্যক্তি) ঘোষণা করে বলেন, অবৈধ দখলদাররা প্রতিনিয়তই কমবেশি নদী দখল করছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে নদী। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হলো। নদীকে মানুষের অধিকার দেওয়া হলো। এখন দেখার বিষয় আমরা আমাদের নদীগুলোকে রক্ষা করতে কতটুকু তৎপর!
নদী ফিরে পাক তার যৌবন। ছন্দ তুলে নেচে নেচে ছুটে চলুক আপন খেয়ালে, সাগরপানে। উচ্ছল হোক, উজ্জীবিত হোক, বহতা হোক নদী। নদী হোক প্রাণ-প্রকৃতির হৃদয়ের স্পন্দন।
লেখক: প্রকৃতিবিষয়ক লেখক