১৯৮৫ সালের ২২ আগস্ট ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার বিমানবন্দর থেকে গ্রিসের কর্ফু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পথে যাত্রা করে ব্রিটিশ এয়ারট্যুরস ফ্লাইট ২৮ আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী ফ্লাইট। তবে ম্যানচেস্টার বিমানবন্দর থেকে টেকঅফের আগেই বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এতে বিমানের ৫৩ জন যাত্রী ও ২ জন ক্রু প্রাণ হারান।
এই উড়োজাহাজ একটি বোয়িং ৭৩৭-২৩৬ সিরিজের নিবন্ধিত ছিল এবং ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহায়ক সংস্থা ব্রিটিশ এয়ারট্যুরস দ্বারা ‘রিভার অরিন’ নামে উড্ডয়ন করা হচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময় বিমানটিতে ১৩১ জন যাত্রী এবং ৬ জন ক্রু ছিলেন। টেকঅফ প্রক্রিয়া চলাকালে জোরে একটি অস্বাভাবিক শব্দ শোনার পর বিমানটির টেকঅফ বাতিল করা হয়। এরপর একটি ইঞ্জিন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। বিমানের ক্যাপ্টেন আগুন লাগার বিষয়টি টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানটি খালি করার নির্দেশ দেন। এতে ৮২ জন বেঁচে গেলেও মূলত প্রচণ্ড ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে না পেরে ৫৫ জনের মৃত্যু ঘটে।
এ দুর্ঘটনাকে ‘সিভিল অ্যাভিয়েশনের ইতিহাসে একটি সংজ্ঞায়িত মুহূর্ত’ গণ্য করা হয়। কারণ এ দুর্ঘটনার পরপরই যাত্রীবাহী সব বিমানের জরুরি বহির্গমন, অগ্নিপ্রতিরোধী সিট কভার, মেঝে আলো, আগুন-প্রতিরোধী প্রাচীর, সিলিং প্যানেল, অগ্নিনির্বাপক এবং জরুরি বহির্গমন দরজার কাছাকাছি বসার সিট বিন্যাসের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।
ব্রিটিশ এয়ারট্যুরস ফ্লাইট ২৮ এম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন পিটার টেরিংটন (৩৯) এবং ফার্স্ট অফিসার ব্রায়ান লাভ (৫২)। ম্যানচেস্টার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে ২৪ থেকে টেকঅফ পর্বের সময় তারা বিমানের নিচ থেকে একটি অস্বাভাবিক আওয়াজ শুনতে পান। একটি টায়ার ফেটে গেছে ভেবে ক্যাপ্টেন তার করণীয় ঠিক করেন। এ সময় ফার্স্ট অফিসার ব্রায়ান বিমানের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন এবং তিনি ৫ সেকেন্ডের জন্য হার্ড ব্রেক প্রয়োগ করেন। ১০ সেকেন্ড পরে ম্যানচেস্টার বিমানবন্দরের টাওয়ার কন্ট্রোল থেকে বিমানটিতে ভয়াবহ আগুন দেখা যায় এবং তারা ক্যাপ্টেনকে যাত্রীদের ডানদিকে নামিয়ে দিতে পরামর্শ দেয়। এরপর বিমানবন্দরের ফায়ার সার্ভিসের দমকলকর্মীরা একটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে এবং প্রচণ্ড ধোঁয়া ও আগুন দেখতে পান। সেই অনুসারে তারা নিজস্ব প্রক্রিয়ায় আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন।
বিমানের সিনিয়র ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট বিমানটি থামার প্রায় ১০ সেকেন্ড আগে সামনের ডানদিকের বহির্গমন দরজা খোলার চেষ্টা করলেও নকশার ত্রুটির কারণে এটি জ্যাম হয়ে যায় এবং তিনি এক পর্যায়ে এ দরজা খোলার প্রচেষ্টা ত্যাগ করেন। এরপর সামনের বাঁদিকের দরজা খোলা সম্ভব হয়। এ দরজার সঙ্গে সফলভাবে জরুরি পরিস্থিতিতে নামার স্লাইডটি স্থাপন করা হয় ও যাত্রীদের নামানো হয়।
এ বিমান ট্র্যাজেডির পর থেকে বাকি জীবন ক্যাপ্টেন পিটার টেরিংটন এক ধরনের অপরাধ বোধের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। তিনি ‘প্রায় প্রতিদিন’ তার পরিবারের সঙ্গে দুর্ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতেন এবং সর্বদা প্রশ্ন করতেন যে, ‘তার আরও কিছু করা উচিত ছিল কি না’। ৫২ বছর বয়সে বিমান চালানো থেকে অবসর নেন এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের সেবায় জীবন কাটিয়ে দেন। এমন বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রেখে যাত্রীদের জীবন রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্য বিমানের দুই ক্রু আর্থার ব্র্যাডবেরি ও জোয়ানা টফ এবং ম্যানচেস্টার বিমানবন্দর ফায়ার সার্ভিসের দুই সদস্য ফায়ারম্যান স্যামুয়েল লিটল ও ফায়ারম্যান এরিক আর্থার ওয়েস্টউড ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কুইন্স গ্যালান্ট্রি মেডেল লাভ করেন। তাছাড়া মৃত্যুবরণকারী দুই ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট শ্যারন ফোর্ড ও জ্যাকিকেও একই সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন