ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৮ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে কথা কেউ শোনে না

কোলাকুলি হলেও খোলাখুলি আলাপ নেই

কালবেলা গ্রাফিক্স
কালবেলা গ্রাফিক্স

স্মরণকালের লম্বা ঈদের ছুটির পর খুলেছে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সবকিছু। যদিও কাজে গতি ফিরতে এ সপ্তাহ কেটে যাবে। অফিস-আদালতে এখন চলছে কোলাকুলি, বকেয়া সালামি আদায় আর বিদায়ী ঈদের রকমারি গল্প। স্বস্তির ঈদযাত্রা হলেও রাজধানীর বস্তিগুলোতে এখনো ফেরেনি প্রাণচাঞ্চল্য। নিম্ন আয়ের মানুষ বরাবরই একটু দেরিতে ফেরে পাষাণ শহরে। অনন্যোপায় হওয়ায় মায়াবী গ্রাম থেকে তাদের অনিবার্য প্রস্থান ঘটে। উন্নত দেশে বিলাসবহুল ছুটি কাটিয়ে ধনীরাও একসময় ফেরে ঢাকা শহরে। কিন্তু সবখানে সব পরিস্থিতিতেই দেশ নিয়ে চলে উচ্ছ্বাস আর হতাশার গল্প। সেমাই ভোজনে নানা বয়সীদের আড্ডায় অনুপ্রবেশ করে রাজনীতি। এ যেন বাঙালির অনিবার্য নিয়তি। ঈদের ছুটির পর কী হবে? নির্বাচনের দাবিতে উত্তপ্ত হতে পারে রাজপথ! ইউনূস সরকার কত দিন থাকবে? নির্বাচন কি আদৌ হবে? এ জাতীয় নানা ইস্যুতে সরগরম ছিল পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন সমাবেশ। পুরো রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ আর বাজার ব্যবস্থাপনায় খুশি সাধারণ জনগণ। চীনে ড. ইউনূসের অচিন্তনীয় সফর আর শ্যামদেশে কৃষ্ণপূজারি মোদি-দর্শন নতুন মাত্রা যোগ করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের ললাটে। সরকারের এসব তৎপরতায় আশাবাদী দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও। যদিও যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ করে ঈদ আনন্দে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তবে ইউনূস সরকারের নিয়োগকর্তা ছাত্রনেতাদের গতানুগতিক রাজনৈতিক তৎপরতায় বিরক্তি প্রকাশ করছেন অনেকে। রাজনৈতিক চাঁদা আদায় আর স্ট্যান্টবাজিতে পুরোনো পথেই হাঁটছে নতুনরা। এর সমালোচনা স্পর্শ করছে সরকারে থাকা বিপ্লবীদেরও। জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তারে সরকারের বিরুদ্ধে সময় দান ও সহযোগিতার অভিযোগ শুরু থেকেই। তাই সাময়িক বা সামরিক নয়, নির্বাচিত সরকারই গণতন্ত্রে ফেরার অন্যতম পথ বলে বারবার মত দিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও সমমনারা।

ঐতিহাসিকভাবেই বিএনপি এ দেশের ক্রান্তিকালের পরীক্ষিত দল। সময় আবারও সুযোগ করে দিয়েছে দলটিকে। গত আট মাসে মুক্তিযুদ্ধ, সার্বভৌমত্ব, সংবিধান ও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় সাহসী ভূমিকা রেখেছে তারা। আরও বিচক্ষণতার পরিচয় দিলে বিএনপি হতে পারে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব সম্প্রদায়ের অভিভাবক। শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়া এরই মধ্যে তার আপসহীন ও উদার ব্যক্তিত্ব দিয়ে জাতির শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন। কিন্তু দলটির একশ্রেণির বুভুক্ষু, দখলবাজ, চাঁদাবাজ নেতাকর্মী প্রতিনিয়ত সুন্দর ভবিষ্যৎকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। দল থেকে বহিষ্কার, পদ স্থগিত করেও থামানো যাচ্ছে না বেপরোয়াদের। তাদের বিরুদ্ধে মামলা এবং আটকও চলছে সমানতালে। দলীয় হাইকমান্ডের কঠোর বার্তা এড়িয়ে অনেকে হাইব্রিড নেতাদের দলে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। সতেরো বছরের নির্যাতন ভুলে কেউ কেউ নিজেই নির্যাতক হয়ে উঠছে। এ সমস্যা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়েছে। এমনকি ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী কর্মী-সমর্থকও নিজেকে বিগত দিনে নির্যাতিত দাবি করে সুবিধা আদায়ে নেমেছে। এতে করে তীরে এসে তরী ডোবার আশঙ্কা করছেন দলটির ত্যাগী ও সাধারণ নেতাকর্মীরা। নির্বাচন দেরি হলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ আলাপ এখন সর্বত্র। যদিও বিএনপি দাবি করছে, ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। সুযোগসন্ধানীরা দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করছে। যাচাই-বাছাই ছাড়াই সামাজিক ও গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হচ্ছে তারা। দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী ফ্যাসিস্ট আমলে হামলা-মামলায় নিঃস্ব হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হাত থেকে লুট হওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য, সহায়-সম্পদ ফিরে পাওয়ার চেষ্টাকে দখল হিসেবে দেখানো হচ্ছে। জামায়াতসহ অন্য দলগুলো সরকারি পদ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশ ভোগ করলেও সমালোচনা কম হচ্ছে। বিএনপি মনে করে, বড় দলের কোটি কোটি সমর্থকের সামান্য ভুলও দ্রুত প্রচার পায়।

আগামীতে ভুল থেকে ভালো কিছু হবে বলে আশা করে বিএনপি। তাদের নেতারা বলেন, গত দেড় দশকে শুধু রাজনীতি নয়, দেশের সামাজিক ভারসাম্যও নষ্ট করে গেছে আওয়ামী লীগ। বিরোধী মত দমনের পাশাপাশি নিজ দলের পোড় খাওয়া ঝানু রাজনীতিবিদদের অকেজো করে ভুঁইফোড়, হাইব্রিড নেতাদের উত্থান ঘটিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য, তোষামোদকারীদের দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে রেখেছিলেন। এ ধারা সমাজের প্রতিটি স্তরে জেঁকে বসে। স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির, হাট-বাজারেও দাপিয়ে বেড়ায় দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসীরা। সেখান থেকে সমাজকে সুস্থধারায় আনতে সময় লাগবে। বিশেষ করে এজন্য দরকার নির্বাচিত কঠোর সরকার। বিএনপির এ বিশ্লেষণ বা উপলব্ধি হয়তো সত্যি। কিন্তু মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে কী করবে? তার চেয়ে আজ কী হচ্ছে, সেটার ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করে। দশটা ভালো কাজকে স্বাভাবিক মনে করে। একটি খারাপ কাজের সমালোচনা করে শতমুখ হয়ে। বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে বিএনপিকে। ‘এখনই এই অবস্থা, ক্ষমতায় গেলে কী করবে’!—বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে এ প্রচারণা এখন তুঙ্গে। বিপরীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের সময় থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নিয়ে পরিকল্পিত প্রচারণায় নেমেছে অনুসারীরা। তারা বলছেন, জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম ইউনূস সরকার আরও কয়েক বছর থাকতে পারে। রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার ও বিদেশি বিনিয়োগে ইউনূস সরকারকে দরকার। সুশীল সমাজের পাশাপাশি বিএনপির সাধারণ, শান্তিপ্রিয় সমর্থকদের কারও কারও মুখেও এরকম কথা শোনা যাচ্ছে। অথচ নিজেদের ৩১ দফার সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তেমন সরব না তারা। সংবিধান সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতবিরোধ থাকার পরও বিএনপি কোলাকুলি করে যাচ্ছে সরকার, জামায়াত, এনসিপি ও গণঅভ্যুত্থানের সহযোগী দল এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঈদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ঈদ ঘিরে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো হাতে নেয় নানা পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হতাহতদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা ও নির্বাচনী প্রচারণা। আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের অনুপস্থিতিতে মাঠ এখন বিএনপি এবং অভ্যুত্থানকারীদের দখলে। সরকার এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঈদ আয়োজনে আমন্ত্রিত ছিলেন তারা সবাই। সেসব অনুষ্ঠানে অনিবার্য আবহসংগীত ছিল—‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী, / সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ, / ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। / আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী এ গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোলাকুলি করেন সবাই। কিন্তু জাগতিক তাগিদের কাছে শতাব্দী প্রাচীন সংগীতের মর্মার্থ সংশ্লিষ্টদের হৃদয়ে কতটুকু ঐকতান তোলে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ঐশী বাণীও মার খায় রাজনীতির কূটচালে। অথচ সবকিছুই হওয়ার কথা মানুষের কল্যাণে। সুন্দর আগামীর জন্য শুধু কোলাকুলি নয়, খোলামেলা আলোচনা দরকার। সরাসরি অনেক অনেক আলাপ হওয়া দরকার। ঢাক গুড় গুড় করে বৈশাখী ঝড় থামানো যায় না। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্ক বাড়ে। ৭১ নাকি ২৪ বড়—এসব প্রশ্নই অবান্তর। প্রশ্নগুলো ঐক্য ভাঙার কারিগর। এ দেশের জন্মের সঙ্গে ৫২, ৫৪, ৬৯, ৭১ এবং গণতন্ত্রের ইতিহাসে ৯০, ২৪ জ্বলজ্বলে মাইলফলক। কোনো ঘটনাকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এ সবকটি সালেই হয় বাংলাদেশের বিশাল অর্জন। একাত্তরে নেতিবাচক ভূমিকায় অনুতপ্ত না হয়ে ২৪-এর জন্য অহমিকা দেখানো ভুল বার্তা দেয় সমাজকে। মুক্তিযুদ্ধের সম্মানে ঘাটতি দেখা দিলে ২৪-এর আত্মাহুতির ভিত্তি থাকে না। দুর্ভাগা জাতি বারবার রক্ত দিয়ে পবিত্র করে দেশ মাকে। আর ষড়যন্ত্রীরা শকুনি দৃষ্টি দিয়ে নোংরা করে মাটি ও মানুষ। গণতন্ত্র ও মানবিকতা প্রতিষ্ঠায় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কালক্ষেপণের সময় নেই। তবে প্রচলিত রীতিতে জনসেবার সুযোগ চাইলে নিজেদের কার্যক্রম দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনআস্থা অর্জন করতে হবে। শুধু নির্বাচন কেন্দ্র করে নয়, প্রতিদিনের কর্মসূচিতে জনগণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাতে জনতাকে বিকল্প শক্তির অপেক্ষায় থাকতে না হয়। কাজী নজরুলের ঈদের ওই একই গানে আরও দুটি লাইন আছে। “তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা, / সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ”।

লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ

‘স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ মানুষের ভালো থাকার জন্য হতে হবে’

ভারতে জরুরি অবস্থা জারির নির্দেশ

লুকিয়ে রাখা ২৯ কেজি ওজনের বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৩ 

হাসনাতের ফেসবুক পোস্টে ৩ দাবি

যানজট ও দুর্ঘটনা রোধে মাঠে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা

রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে জবি শিক্ষার্থী ৩ দিনের রিমান্ডে

মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছে ‘সোনারগাঁ’ : মামুনুল হক

‘এ দেশে আ.লীগের নেতাকর্মীদের ভাত নেই’ 

ফিল্ম আর্কাইভে জাতীয় চলচ্চিত্র সংসদের সম্মেলন

১০

‘শাহবাগে বড় স্ক্রিনে দেখানো হবে জুলাই গণহত্যার ডকুমেন্টারি’

১১

নাসিরনগরে দুপক্ষের সংঘর্ষে কৃষক নিহত 

১২

‘সবাইকে কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে একযোগে কাজ করতে হবে’

১৩

ভারতের ৩৬ জায়গায় পাকিস্তানের ৪০০ হামলা

১৪

কর্ণফুলীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ সিএমপি কমিশনারের

১৫

অভিযোগও ভারতের, রায়ও ভারতের, হামলাও ভারতের : পাকিস্তান সেনার মুখপাত্র

১৬

আ.লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য সাগর গ্রেপ্তার

১৭

ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায় : সারজিস

১৮

‘এই দেশ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়, জণগণের’

১৯

পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াল আরও এক মুসলিম দেশ

২০
X