বাংলাদেশের শহরগুলো প্রতি গ্রীষ্মে প্রচণ্ড রোদে ঝলসে যায়। এ উত্তপ্ত বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—দেশটি ক্রমাগত ভয়াবহ ও নিয়মিত তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হচ্ছে। গত এক দশকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় চরম গরমের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং দৈনন্দিন জীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নির্মিত পরিবেশ—ভবন, আবাসন ও জনস্থানগুলোকে শুধু একবার নয়, ধারাবাহিকভাবে অভিযোজন করতে হবে।
শুধু তাপপ্রবাহ ঘটার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। টেকসই মানব অভিযোজনের অংশ হিসেবে আমাদের নিয়মিতভাবে শহর ও ভবন পরিকল্পনা, সংস্কার এবং ব্যবহারে মনোযোগ দিতে হবে। যদি শহরগুলো ধারাবাহিক অভিযোজনে ব্যর্থ হয়, তবে সেগুলো আরও গরম ও বাসযোগ্যতা হারাবে—বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য।
এর প্রধান কারণ হলো, জলবায়ু পরিবর্তন একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাপমাত্রা অনিশ্চিতভাবে বাড়ছে এবং শহুরে তাপদ্বীপ প্রভাব (Urban Heat Island Effect) প্রতি বছর আরও তীব্র হচ্ছে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে নির্মিত ভবনগুলোও এখন পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে পারছে না। গতকালের সমাধান আজকের সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে যদি নিয়মিত মূল্যায়ন ও সংশোধন না করা হয়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ বাড়ির দিকে তাকালে দেখা যায়—খড়ের ছাউনি, মাটির দেয়াল এবং প্রশস্ত বারান্দা প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা রাখত ঘর। অথচ এখন কংক্রিটের ভবনগুলো তাপ ধরে রাখায় ঘরের ভেতর তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠছে। তাই প্রতি বছর ভবনগুলোর ছাদে তাপ-প্রতিফলক রং, সবুজ ছাদ, উন্নত বায়ুচলাচল ব্যবস্থা এবং ছায়া তৈরি করা যায় এমন নকশা (ক্যানোপি বা বারান্দার বিস্তৃতি) সংযোজনের প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের আহমেদাবাদ শহর দেখিয়েছে যে, বার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে জীবন বাঁচানো যায়। ২০১০ সালের মারাত্মক তাপপ্রবাহের পর তারা ‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’ চালু করে, যা প্রতি বছর হালনাগাদ হয়। এ পরিকল্পনায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নির্মাণ উপকরণের উন্নয়ন, শীতল কেন্দ্র স্থাপন এবং আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—ফলে শহরে তাপজনিত মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও স্থানীয় উপযোগী করে এমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
তাপ অভিযোজনে স্থাপত্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর আমাদের নির্মাণবিধি ও নকশা নির্দেশিকা সর্বশেষ গবেষণার ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা উচিত। ভবনের অভিমুখ নির্ধারণ, প্রাকৃতিক বায়ু চলাচলের সুযোগ রাখা এবং স্থানীয়, শ্বাস-প্রশ্বাসযোগ্য উপকরণ ব্যবহারের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করা উচিত। বিশেষ করে স্কুল, হাসপাতাল ও বাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জনস্থানের নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পেতে হবে।
সহজ কিছু কার্যকর কৌশল এরই মধ্যে বিদ্যমান। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহর হালকা রঙের ছাদ ও রাস্তা ব্যবহারের মাধ্যমে তাপমাত্রা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। একইভাবে, ঢাকা ও অন্যান্য শহরে আর্কিটেক্ট এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা স্থানীয়ভাবে তাপ-নিরাপদ নির্মাণ পদ্ধতি প্রচার করতে পারেন। পাশাপাশি শহরের খোলা স্থান, পার্ক, লেক ও সবুজ করিডোর সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণও জরুরি। এগুলো কেবল সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং শহর ঠান্ডা রাখার জন্য অপরিহার্য ব্যবস্থা।
প্রতি বছর স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে জনস্থানে গরমের সময়ও আরামদায়ক থাকার নতুন নতুন ধারণা উৎসাহিত করা যেতে পারে। বার্ষিক অভিযোজন কৌশল অবশ্যই গবেষণাভিত্তিক এবং জনগণকেন্দ্রিক হতে হবে। শুধু নীতিনির্ধারকদের নয়, বাড়ির মালিক, নির্মাণশ্রমিক এবং স্থানীয় গৃহনির্মাতাদেরও সচেতন করা প্রয়োজন। প্যাসিভ কুলিং প্রযুক্তি শেখানোর জন্য সাধারণ কর্মশালা বা ছায়া তৈরি ডিভাইস স্থাপনে ভর্তুকি প্রদান বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
জাপানের ‘গ্রিন কার্টেন’ প্রকল্পের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের উৎসাহিত করা যেতে পারে যাতে তারা নিজেদের বাড়ির সামনে লতাগুল্মের পর্দা তৈরি করে স্বাভাবিকভাবে শীতলতা বৃদ্ধি করে এবং শক্তি খরচ কমায়। বাংলাদেশের শহরগুলো দ্রুত বাড়ছে, কিন্তু তা হতে হবে স্মার্টভাবে।
তাপ অভিযোজন পরিকল্পনা শহর উন্নয়নের এক অনিবার্য অংশ হতে হবে—বসতবাড়ি, পরিবহনকেন্দ্র এবং জনপরিসরে তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রতি বছর খতিয়ে দেখতে হবে—কী কাজ করেছে, কী করেনি এবং কী নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে। ধারাবাহিকভাবে শেখা ও কাজ করাই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা থেকে টিকে থাকার পথ।
জলবায়ু পূর্বাভাস বলছে, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে গ্রীষ্ম হবে দীর্ঘ ও আরও বেশি গরম। প্রতি বছর অভিযোজন পরিকল্পনা ছাড়া শহরগুলো অবাসযোগ্য তাপের ফাঁদে পরিণত হবে। তবে আর্কিটেকচারাল উদ্ভাবন এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা এমন শহর গড়ে তুলতে পারি, যা শুধু উত্তাপ সহ্য করবে না, বরং মানুষের সুস্বাস্থ্য ও আরাম নিশ্চিত করবে।
একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ুর দেশে, আমাদের নির্মিত পরিবেশও দ্রুত অভিযোজিত হতে হবে। বার্ষিক অভিযোজন কোনো বোঝা নয়—এটি ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। আমাদের ভবন ও শহরগুলোকে আমাদের রক্ষা করতে হবে, বিপদে ফেলে দিতে নয়। আজ থেকেই উদ্যোগ নিতে হবে প্রতি বছর কৌশল পর্যালোচনা ও উন্নয়ন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ, টেকসই ও দৃঢ় শহর নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: স্থপতি, শিক্ষাবিদ এবং চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান
মন্তব্য করুন