ড. মো. আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ০৯:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছাত্রদল কেন টার্গেট

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগ সৃষ্টি হওয়ার এক বছর আগেই ছাত্রলীগের জন্ম। সংগঠনটির জন্ম ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। পাকিস্তানবিরোধী পুরো আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে সংগঠনটি লড়ে গেছে। এমনকি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিল অগ্রগামী। যার দরুন সংগঠনের প্রতিটি নেতাকর্মীর ভেতর এক ধরনের লড়াকু মনোভাব, স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ছিল, প্রতি বছর কাউন্সিল হতো, নেতৃত্বেও পরিবর্তন হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যখনই এ সংগঠনটি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হলো, হয়ে উঠল সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্রাশফায়ারে হত্যা, ব্যালট বাক্স লুট, ধর্ষণ ও রক্ষী বাহিনীর দোসর ইত্যাদি ছিল মুজিববাদী ছাত্রলীগের অলংকার। এরকম একটি দানবীয় ছাত্র সংগঠন থেকে ভবিষ্যতে আর যাই হোক; দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারণকারী এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতা তৈরি হতে পারে না। বিষয়টি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মনে ভীষণ দাগ কাটে। তিনি ছাত্ররাজনীতির আমূল পরিবর্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে বারবার আলোচনায় বসেন। অতঃপর অম্লমধুর অভিজ্ঞতায় তৈরি হয় অরুণ প্রাতের তরুণ দল, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।

এক. তারিখটা ১৯৭৬ সালের ২৬ অক্টোবর, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করার জন্য ক্যাম্পাসে আসেন। ক্যাম্পাস চত্বরে তার আগমনে অসন্তুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ও বহিরাগত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে দেখামাত্রই বিভিন্ন আপত্তিকর স্লোগান দিতে থাকে এবং একপর্যায়ে তার গায়ে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তৎক্ষণাৎ তার নিজস্ব সব সিকিউরিটি প্রটোকল ঠেলে ছাত্রদের কাছে গিয়ে জানতে চান—‘বাবারা তোমরা কী চাও? আমাকে বলো। আমাকে অপমান করে স্লোগান দিলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? তোমরা তোমাদের সব দাবি আমার কাছে উত্থাপন করো, আমি সব মেনে নেব।’ তারপরও উপস্থিত ছাত্ররা স্লোগান অব্যাহত রাখে এবং অসম্মানকর উক্তি চলমান রাখে। গুটি কয়েক ছাত্র বহিরাগতদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে অপমান করছে, এ কথা দ্রুতবেগে ক্যাম্পাসে রটে গেলে, বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল নিয়ে উপস্থিত হয় এবং সঙ্গে শিক্ষকরাও। সবাই তখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে সম্মান জানান। সেদিনের পর থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যেচে পড়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে আসল। তিনি খোলামনে তাদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপ করতে থাকেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা অনুভব করলেন, এভাবে অসংগঠিত থাকলে ছাত্রসমাজের উন্নয়ন কখনো হবে না। তারা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বিভিন্নভাবে মোটিভেট করতে থাকে একটি ছাত্র সংগঠন করার জন্য। দুই মাস আলাপ-আলোচনার পর তিনি রাজি হলেন একটি ছাত্র সংগঠন করার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমান ছাত্রদলকে সুসংগঠিত করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা কাজী আসাদুজ্জামানকে প্রথম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেন এবং সঙ্গে শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক করেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে (বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য)। জিয়াউর রহমান ছাত্রদলকে নিয়ে খাল খননে অংশ নেন, যা ছিল ওই সময়ের ক্রেজ। ১৯৯০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ডাকসু, বাকসু, ইউকসু, বামেকসু, ঢামেকসুসহ বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৩০৮টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ/কলেজের ছাত্র সংসদে ছাত্রদল পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয়। এটা একটা রেকর্ড, যা একমাত্র ছাত্রদলেরই আছে।

দুই. প্রথমদিকে ছাত্রদল মূলত শিক্ষার্থীদের মধ্যে শহীদ জিয়ার আদর্শ ও জাতীয়তাবাদী দর্শন প্রচার ও চর্চা, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং বিএনপির রাজনৈতিক কার্যক্রমে সমর্থন ও অংশগ্রহণ করত। রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুও পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়টা ছিল স্বৈরাচার এরশাদের ঘৃণিত অধ্যায়। এ সময়ে মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কান্ডারি ছিল শহীদ জিয়ার হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন, ছাত্রদল। এই আন্দোলনের ফলেই এরশাদের পতন ঘটে এবং দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। সেই সময়ে ছাত্রদলের বহু নেতাকর্মী আহত, নিখোঁজ ও খুন হয়। পতিত ও পরাজিত শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) রাজপথের পরীক্ষিত তরুণ তুর্কি ছিল ছাত্রদল এবং ওই সময়ের সব আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রদল জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত হাতিয়ার হিসেবে বিএনপির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। ফলে আধিপত্যবাদী ও দেশীয় ষড়যন্ত্রে এক-এগারোর বিরাজনীতিকরণের উত্তাল সময়ে জিয়া পরিবারের সঙ্গে এই ছাত্রদলের ওপর খড়গ নামে। মাঠ কাঁপানো ছাত্রদলের নেতাদের জেলে ভরে এবং তাদের জীবনে নেমে আসে দুঃসহ নির্যাতন এবং লম্বা কারাবাস। ফ্যাসিস্ট হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদকাল (২০০৯-২০২৪) ছিল ছাত্রদলকে নির্মূল করার মাস্টারপ্ল্যান; কারণ সে জানত ছাত্রদল লড়াকু ও বিএনপির প্রাণভোমরা।

তিন. খুনি হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ২০১৫ সালে পুলিশ লীগ সরাসরি ক্রসফায়ারে হত্যা করে ছাত্রদলের নুরুজ্জামান জনি ও কবির হোসেন রনিকে। এমনকি ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে মাত্র পাঁচ মাসে এ সংগঠনের ৩১২ জন নেতাকর্মী খুন ও গুম হয়, যার মধ্যে ৬৫ জন সরাসরি অ্যানফোর্স ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স হয়। গুম হওয়া ছাত্রদলের নেতাদের মধ্যে রয়েছে মাজহারুল ইসলাম রাসেল, আতিকুর রহমান রাসেল, মাহবুব হাসান সুজন, কাজী ফরহাদ হোসেন প্রমুখ। গত বছর ১৭ দিনের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে একক সংগঠন হিসেবে ছাত্রদলের ৪৯ জন নেতাকর্মী খুনি হাসিনার পুলিশ লীগের সামনে বুকের ছাতি ৬৫ ইঞ্চি দেখিয়ে শহীদ হয়েছে। শহীদদের ভেতর ছাত্রদলের পোস্টধারী চট্টগ্রাম কলেজ শাখার ছাত্রদলের সদস্য ওয়াসিম আকরাম ও মাগুরা জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাব্বী এবং সর্বশেষ মৃত্যু কাফেলায় শরিক হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্য। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সংগঠনটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এরশাদ, হাসিনা, মইন-ফখরুদ্দিন, হাসিনা; এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও ছাত্রদলের হাজারের ওপর নেতাকর্মী শাহাদাতবরণ করেছে।

যেসব গোষ্ঠী আমাদের দেশে আধিপত্যবাদের সম্প্রসারণ চায়, নতজানু পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী, যারা সিকিমের লেন্দুপ দর্জি মার্কা স্বাধীনতা চায়, যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক হারমনি ধ্বংস করতে চায়, তাদেরই টার্গেট ঘুরেফিরে ছাত্রদল। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা এবং স্বৈরশাসকের হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একমাত্র পরীক্ষিত ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্রদল অতন্ত্র প্রহরীর মতো ছিল, আছে এবং থাকবে।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স / রোগীদের নিম্নমানের খাবার দেওয়ার অভিযোগ

কলম্বোতে টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ, একাদশে ফিরেছেন মিরাজ

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে হাওরে হাউসবোট দখলের অভিযোগ 

বৃহস্পতিবার শুরু এইচএসসি, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

অতর্কিত হামলায় ইসরায়েলের ৭ সেনা নিহত

দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন ওএসডি

লাল ডিম না সাদা ডিম, কোনটির পুষ্টিগুণ বেশি

ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে দুটি সংবাদমাধ্যম, ট্রাম্পের ক্ষোভ

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন / বাঙ্কার বাস্টারেও ধ্বংস হয়নি ইরানের পরমাণু কেন্দ্র

ইরানে ফের হামলার চেষ্টা, ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত

১০

রাজশাহী মহানগরীর থানা-ওয়ার্ড যুবদলের কমিটি গঠনে সতর্ক চিঠি

১১

ভুল রক্ত পুশ করায় মৃত্যুর মুখে রোগী, পাশে দাঁড়ালেন ইউএনও

১২

একযোগে ৩৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা

১৩

চিনি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা 

১৪

খামেনির বিপদ কাটেনি, সামাল দিতে হবে নিজ জাতির ক্ষোভ

১৫

ইরানে যুদ্ধের অবসান : তেহরানের বর্তমান পরিস্থিতি

১৬

মাঝ নদীতে ভাসছিল ৪০ যাত্রীসহ ট্রলার, এরপর যা ঘটল

১৭

বিএনপিতে দখলবাজ নেতাকর্মীর স্থান নেই : মিফতাহ্ সিদ্দিকী

১৮

সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিককে কুপিয়ে জখম

১৯

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

২০
X