দেশে আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ‘এ পুলিশকে লইয়া অন্তর্বর্তী সরকার কী করিবে?’ বিদ্যমান অবস্থায় পুলিশ নিয়ে আরও প্রশ্ন আছে। নির্বাচনের সময় ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সংস্কার ও বিচারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হলে ফেব্রুয়ারি প্রথম ভাগে নির্বাচন হতে পারে। এর আগে ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ৬ জুন দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথম ভাগে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেন। প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী এখন থেকে আট মাস পর নির্বাচন হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন তো হবে, পুলিশ প্রস্তুত তো? এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আইনশৃঙ্খলার আমূল পরিবর্তন করা না গেলে এই পুলিশকে দিয়ে সুষ্ঠু ভোট করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের দশ মাসেও পুলিশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। বড় ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকেই এগিয়ে আসতে হচ্ছে। যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১৫ জুন রাজধানীতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদর দপ্তর এবং র্যাব-১ অফিস পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নির্বাচনে নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব অবস্থার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। উপদেষ্টা যেদিন অর্থাৎ গত শনিবার উত্তরায় এপিবিএনের সদর দপ্তর পরিদর্শন করেন, সেদিনই সকালে উত্তরায় র্যাবের পোশাক পরে অস্ত্র দেখিয়ে একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের চার কর্মচারীর কাছ থেকে কোটি টাকা ছিনতাই করা হয়। জনজোটের সহিংসতা (মব ভায়োলেন্স) কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। তথ্য পরিসংখ্যান যা বলে, সঙ্গে দেখা যায় যে, স্বাধীনতার পর থেকে আর কোনো সরকারের সময় গণপিটুনি বা মব সহিংসতায় এত মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপিটুনিতে গত ৯ মাসে ১৬৩ জন নিহত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে দেশে গণপিটুনি দিয়ে হত্যাকাণ্ড কীভাবে বেড়েছে, তা উঠে এসেছে মানবাধিকার সংস্থা আইন সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যানে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের মাস গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। গত বছরের শেষ পাঁচ মাসে ৯৬ জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর চলতি বছর প্রথম চার মাসে ৬৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আসকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে গণপিটুনিতে নিহতদের মধ্যে শুধু ঢাকা বিভাগেই ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আরও দুয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। মিরপুর ১০ নম্বরে প্রকাশ্যে এক মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসায়ীর পায়ে গুলি করে ২২ লাখ টাকা ছিনতাই করা হয়। যদি এ ঘটনার ১৮ দিন পার হওয়ার পর র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং থানা পুলিশ যৌথভাবে তদন্ত চালিয়ে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরই মধ্যে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। গাজীপুরের শ্রীপুরে এটিএম বুথে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক পোশাকশ্রমিক।
সহিংস জনজোট গণপিটুনি দিয়ে শুধু মানুষ হত্যা নয়, এ পর্যন্ত অসংখ্য নারীকে প্রকাশ্যে হেনস্তা করেছে। শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নারী। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সারা দেশে অসংখ্য মাজার ভাঙা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের উৎসব, গানের অনুষ্ঠান, নাটক মঞ্চায়ন, সিমেনা প্রদর্শনী পণ্ড করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা এখনো ঘটেই চলেছে। এ প্রসঙ্গে আরও দুয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে চুরির অভিযোগে এক নারীকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের পর চুল কেটে দেওয়া ও বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, স্থানীয় শতাধিক বাসিন্দা নারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তার মাথার কাপড় সরিয়ে দিচ্ছে। আনন্দ উল্লাস করছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আসামিদের ছাড়িয়ে নিতে থানা ঘেরাও করে শতাধিক গ্রামবাসী (সমকাল, ১২ জুন)।
জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে সমগ্র পুলিশ বাহিনী এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। ফ্যাসিবাদী শাসনের মেয়াদে পুলিশের একটি বড় অংশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনপীড়নে এবং দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে অনেকেই। জুলাই-আগস্টে পুলিশের অতি উৎসাহী সদস্যরা হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠেন। লাশ স্তূপ করে আগুনে পুড়িয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ফলে অভ্যুত্থানের পর পুলিশও জনরোষের শিকার হয়েছে। এ সময় পুলিশ যে মাত্রায় আক্রমণের শিকার হয়েছে, অতীতে আর কখনো এমন হয়নি। এসব আক্রমণের ঘটনায় পুলিশের ৪৪ সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা, ফাঁড়ি, রাজধানীর থানা ও পুলিশ বক্সসহ চার শতাধিক স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সহকর্মীদের নির্মম মৃত্যু, থানা ফাঁড়িতে আগুনের ঘটনা পুলিশ বাহিনীকে ‘ট্রমা’র মধ্যে ফেলে দেয়। সব সরকারের আমলে পুলিশ রাজনৈতিকভাবে কমবেশি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের মতো এমনটি আর কখনো দেখা যায়নি। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের কারিগর ছিল পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে এমনটি মনে হয়েছে, পুলিশ রাষ্ট্রের বাহিনী না থেকে সরকারি দলের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে পুলিশের মধ্যসারি থেকে শীর্ষপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা বেপরোয়া হয়ে পড়েন। জড়িয়ে পড়েন ব্যাপক দুর্নীতিতে। তাদের অনেকে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।
অন্তর্বর্তী সরকার দশ মাস অতিবাহিত করেছে। এখন পুলিশের আর নাজুক অবস্থায় থাকার কথা নয়। এরই মধ্যে বিগত সরকারের সময় পদোন্নতিবঞ্চিতদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পুলিশের শীর্ষপর্যায়ে অনেক রদবদল করা হয়েছে। অনেককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারপরও কেন আইনশৃঙ্খলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না? দশ মাস ধরে সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের বাইরে রাখা ঠিক হচ্ছে কি না, তাও ভেবে দেখার বিষয়। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাওয়ায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দায়িত্ব পালন শেষে সেনাবাহিনী ছুটি করতে চায়।’ অর্থাৎ, সেদিন তিনি সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাই বুঝিয়েছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার ‘দেশের ইতিহাসে সেরা নির্বাচন’ উপহার দেওয়ার কথা বলেছেন। সর্বশেষ লন্ডন সফরের সময় তিনি একই কথার পুনরুল্লেখ করেন। গত ১১ জুন লন্ডনে চ্যাথাম হাউসের সংলাপে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আগামী নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। সময় ঠিক ও জনগণ প্রস্তুত।’ অনেকেই বলছেন, ‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না’—এমন প্রসঙ্গ তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রফেসর ইউনূস ‘সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন’ করার ঘোষণা দেন। এ প্রসঙ্গ তিনি আরও বলেন, ‘১৭ বছর পর একটি সত্যিকার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। জনগণ সত্যিই ভোট দিতে যাচ্ছে। নতুন ভোটাররা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে ভোট দেওয়ার জন্য। তাদের কণ্ঠকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ নিয়েই বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আগামী নির্বাচন একটা নতুন সরকারের জন্য রুটিন ভোট নয়। এটা নতুন বাংলাদেশের জন্য ভোট।’ প্রধান উপদেষ্টা এর আগে ১৯ এপ্রিল এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসের (এএনএফআরইএল) প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে বলেছিলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই, এ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা এবং দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক মাইলফলক।’ সরকারপ্রধানের আসন থেকে যখন এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়, তখন এই বক্তব্যকে সরকারের অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তবে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, আইনশৃঙ্খলার এখনো যে অবস্থা, তাতে করে প্রধান উপদেষ্টার ‘দেশের ইতিহাসের সেরা অথবা সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন’ করার অঙ্গীকার সমর্থন করে কি না?
এর আগে পুলিশকে শক্ত থাকার বার্তা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাত মাসেরও বেশি সময় পর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ বার্তা দেন। গত ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশেষ এ বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেন। প্রফেসর ইউনূস সেদিন পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘যেহেতু নির্বাচন আসছে, নানা সমস্যা হবে, নানা চাপ আসবে। সবাই বেপরোয়া হয়ে যাবে। পুলিশ কর্মকর্তাদের দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’ প্রধান উপদেষ্টা সেদিন পুলিশ বাহিনীকে ‘শক্ত হওয়ার’ নির্দেশ দেওয়ার পর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই তিন মাসে পুলিশ কি আদৌ শক্ত হতে পেরেছে? আইনশৃঙ্খলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে?
পুলিশ এখনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুরোপুরি সক্ষম, এ কথা মোটেই বলা যাবে না। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে। গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র লুট হয়েছে, যা পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। কারাগার থেকে পালিয়ে গেছে অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী, এদের সবাই এখনো ধরা পড়েনি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে লুট হওয়া এসব অস্ত্রের ব্যবহার ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের আচরণ কেমন হবে, বর্তমান পরিস্থিতি দিয়েই প্রমাণ করা যায়। বড় দলের মনোনয়ন পাওয়া ও বঞ্চিতদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কাও রয়েছে। নির্বাচনী প্রচার ও গণসংযোগের সময় পরিস্থিতি হয়তো উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচনের দিনের কথা আপাতত সরিয়ে রেখে এখন জানতে চাওয়া যেতেই পারে, নির্বাচনের প্রাক-পরিস্থিতি মোকাবিলায় এ পুলিশ কতটা সফল হবে? সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি হিসেবে পুলিশকে দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
লেখক: কলাম লেখক
মন্তব্য করুন