জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী-জনতার কোটা সংস্কার থেকে ফ্যাসিবাদ পতন আন্দোলনের এই বর্ষপূর্তিতে আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বীর শহীদদের। জুলাই ২০২৪-এ এই মহান আত্মত্যাগ জাতি হিসেবে আমাদের গর্বিত করেছে। হিংস্র ফ্যাসিস্টের ভয়ংকর আগ্রাসনের শিকার হয়ে যারা আজও হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে, তাদের প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। জুলাইয়ের জনযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আহত যোদ্ধাদের পরিপূর্ণ সুস্থতা কামনা করছি। গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মানুষের আন্তরিক ও বীরোচিত অবদানকে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের যে আন্দোলন শুরু হয়, তা দ্রুতই বৃহৎ আকার ধারণ করে। ফ্যাসিবাদের নিষ্পেষণে শত অত্যাচারের শিকার কোটি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ছাত্রদের সেই কোটা আন্দোলন ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে বেগবান হতে থাকে। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের ন্যায্য দাবিতে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী সরকারের নির্মম শাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড শক্তিশালী গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
আন্দোলন দমাতে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের কঠোর দমনপীড়ন রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষ নিহত হয়। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আহত-নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এদিকে শিক্ষার্থীদের অবিচল সংগ্রাম দৃঢ় থেকে আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। সাধারণ জনগণের সমর্থনে আন্দোলন আরও তীব্র হতে থাকে। আন্দোলন এক দফায় পর্যবসিত হয়। কোটাসহ সব ধরনের বৈষম্য অবসানে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের এক দফায় মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অবশেষে, ব্যাপক জনবিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। উপায়ান্তর না পেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। বিপ্লব বাস্তব হয়ে ওঠে। এই বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে জনগণের সম্মিলিত শক্তির উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত হিসেবে নন্দিনী হয়।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমেরিকান ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতায় লিখেছেন, ‘April is the cruellest month, breeding Lilacs out of the deadland, mixing memory and desire, stirring dull roots with spring rain.’ অর্থাৎ এপ্রিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস, মৃতভূমি থেকে লাইলাক জন্ম নেয়, স্মৃতি এবং আকাঙ্ক্ষাকে মিশিয়ে নেয়, নিস্তেজ শিকড় বসন্তের বৃষ্টি দ্বারা আলোড়িত হয়।
বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের এমন এক সন্ধিক্ষণে উপস্থিত যখন রক্ত মিশিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে। এত রক্ত যুদ্ধের সময় ব্যতীত গত ১০০ বছরে এ উপমহাদেশে কখনো আর ঘটেনি। বিগত প্রায় ১৬ বছর বসন্ত আসেনি। সব সম্ভাবনা পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছিল প্রচণ্ড দাবদাহে। স্বৈরাচারী ভয়াল এক শাসকের রক্ত পিপাসায় হাহাকার উঠেছিল জনমনে। আর ঠিক এমন সময়ে আসে গণবিক্ষোভ, গণআন্দোলন। নিশ্চিত এমন জেনেই এলিয়ট লিখেছিলেন… নিস্তেজ শিকড় বসন্তের বৃষ্টি দ্বারা আলোড়িত হয়।
প্রতিটি স্বৈরাচারী সরকারই গণবিক্ষোভের ভয়ে সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকে। অতি সাধারণ, অতি ন্যায্য কোনো দাবির মধ্যেও নিজেদের ক্ষমতা হারানোর অশনিসংকেত দেখতে পায়। কৃত্রিম ক্ষমতানির্ভর ও অস্ত্রের জোরে নিজেকে আড়াল করে রাখা এই অবৈধ শাসকরা তাই জনমনে সর্বদা ভয় জাগিয়ে রাখে। ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে রাখে চারদিকে। ফ্লোরেনটাইন দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি রচিত গ্রন্থ ‘দ্য প্রিন্স’ (কীভাবে ক্ষমতা অর্জন করতে হয়, একটি রাষ্ট্র তৈরি করতে হয় এবং এটি বজায় রাখতে হয় তার একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ)-এ প্রিন্সকে ভালোবাসা ও ভয়ের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে বলেছেন এবং প্রাধান্য দিয়েছেন ভয়কে। তবে সাবধান করেছেন জনগণের ঘৃণা থেকে। বাংলাদেশে গত জুলাই-আগস্টে যা হয়ে গেল তার সঙ্গে আরব বসন্তের মিল পাওয়া যায়। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দুর্নীতি, গুম-খুন আর দুঃশাসনে মোহাম্মদ বুয়াজিজির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল তিউনিসিয়ার জনগণ। ক্রোধে একজন ফল বিক্রেতা নিজের শরীরে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ করেন। আর এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ অতঃপর ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকা অবৈধ শাসনের পতন ঘটায়।
ইতিহাসের পাতায় ‘বাংলার বসন্ত’ হিসেবে চিহ্নিত হবে ২০২৪ সালের জুলাই মাস। ২০ বছর হলো প্রায়, বাংলাদেশে কোনো বৈধ শাসক নেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের ক্ষমতার দখলদার আওয়ামী লীগ। দালাল এ সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, লুটপাট, অপশাসন, গুম-খুন, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে তীব্র কষ্টে থাকা জনগণ অবশেষে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ১৬ জুলাই। মানুষ দেখতে পায় এ দেশের শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি নিয়ে দখলদার সরকারের ভয়াবহ সব তামাশা।
অগ্নিগর্ভে বিস্ফোরণের জন্য একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট। দখলদার অথচ নার্ভাস একটি সরকার দলীয় সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রীয় খুনি বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে কমপক্ষে এক হাজারজনের অধিক খুন এবং ৪০০ মানুষকে অন্ধ ও পঙ্গু করেছে। হাজারেরও বেশি মানুষকে আহত করেছে মাত্র তিন দিনে। বিশ্ববাসীর কাছে পরাজয়ের নমুনা হিসেবে কারফিউ জারি করেছে। এমনকি ইন্টারনেট যোগাযোগও বন্ধ করেছে।
৩৫ বছর আগে ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিশাল এক গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিল ছাত্র-জনতা। এ আন্দোলনও ছিল মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দুর্নীতি, গুম-খুন আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। সেখানে ১০ লাখ সাধারণ মানুষ সংহতি জানিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত প্রতীকী ছবিগুলোর একটি হলো এই আন্দোলনের বিশেষ এক ছবি—সেনা ট্যাঙ্কের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছেন একজন আন্দোলনকারী, ঠিক যেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ আবু সাঈদ।
ইতিহাস অনুযায়ী, বিশ্বে যেসব স্টুডেন্ট ম্যাসাকার হয়েছে, তার মধ্যে ঢাকায় গত জুলাই-আগস্টে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, সেটা ছিল সেকেন্ড লারজেস্ট স্টুডেন্ট ম্যাসাকার। উল্লেখ্য, চায়নার তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ১০ হাজার ছাত্র হত্যা করা হয়। যদিও তৎকালীন চীনের কমিউনিস্ট সরকার দাবি করেছিল, ২০০ জন নিহত হয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালের ব্রিটিশ কূটনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, সেখানে ১০ হাজার ছাত্র নিহত হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের দাবিও অনেকটা একই ধরনের। মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৃষ্টির মতো গুলিতে এত যে রক্ত ঝরেছে, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলদারীদের পতন না হওয়া পর্যন্ত মানুষের ক্ষোভ আর প্রশমিত হবে না।
ইতিহাসে কখনো এমন সময় আসে যখন অনেক বছরের ঘটনা একসঙ্গে ঘটে যায়। গণঅভ্যুত্থানের প্রতীকরূপে বাংলাদেশে দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব এ অভ্যুত্থান ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করে। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের এ বিজয় বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের নিরঙ্কুশ বিজয়। আমরা যেন বিজয় ইতিহাসের এই অংশ থেকে কখনোই নিজেদের বিচ্ছিন্ন না করে ফেলি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের স্থায়ী রূপ তৈরি করাই হোক সবার একান্ত কাম্য। ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। সমাজের সব অংশের মানুষ স্বচ্ছ-সুন্দর, মুক্ত-স্বাধীন এবং নিরাপদ এক বাংলাদেশের আস্বাদ অনুভব করুক—এই হোক অঙ্গীকার।
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ডিরেক্টর (ফিন্যান্স) জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন
মন্তব্য করুন