জুলাই সনদ ও সংস্কার নিয়ে লিখতে গিয়ে সাংবাদিক সাহিত্যিক যাযাবরের বহুল পঠিত ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থের কথা মনে পড়ে গেল। হয়তো কিছুটা প্রাসঙ্গিক হবে বিবেচনায় এখানে সেই কিংবদন্তি কাহিনির প্রসঙ্গ টেনে আনা। কাহিনি মোটামুটি এরকম— পাঠান সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি সে সময়ের দিল্লির একপ্রান্তে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। তার মৃত্যুর দীর্ঘকাল পর এক ফকির এলেন সেই মসজিদে। নাম নিজামউদ্দিন আউলিয়া। জায়গাটি তার পছন্দ হলো। সেখানেই রয়ে গেলেন এই মহাপুরুষ। ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল তার পুণ্যখ্যাতি। দ্রুতবেগে বেড়ে গেল তার অনুরাগী ও ভক্তের সংখ্যা। স্থানীয় গ্রামে পানির অভাবের দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। তিনি মনস্থির করলেন একটি দীঘি খননের। যেখানে তৃষ্ণার্তরা পানি পাবে, গ্রামের বধূরা কলসি ভরবে এবং নামাজের আগে অজু করে পবিত্র হবেন মসজিদের প্রার্থনাকারীরা। কিন্তু তার সংকল্প বাধা পড়ল অপ্রত্যাশিতরূপে। প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান গিয়াসউদ্দিন তোগলকের বিরক্তিভাজন হলেন (তার দৃষ্টিতে সামান্য ফকির) নিজামউদ্দিন আউলিয়া। আউলিয়ার দীঘি কাটাতে মজুর চাই প্রচুর। গিয়াসউদ্দিনের নগর তৈরি করতেও হাজার হাজার মানুষ দরকার। অথচ দিল্লিতে মজুর সংখ্যা অত্যন্ত কম। দুই জায়গায় প্রয়োজন মেটানো অসম্ভব। অত্যন্ত স্বাভাবিক, সুলতান চাইলেন মজুররা আগে শেষ করবে তার কাজ, ততক্ষণ অপেক্ষা করুক ফকিরের খয়রাতি খনন। কিন্তু রাজার জোর অর্থের আর আউলিয়ার জোর হৃদয়ের, যার কোনো সীমা নেই। মজুররা দলে দলে কাটতে লাগল নিজামউদ্দিনের দীঘি। সুলতান হুংকার ছাড়লেন... ‘তবে রে...’ কিন্তু তার ধ্বনি আকাশে মেলাবার আগেই এত্তেলা এলো আশু কর্তব্যের। বাংলাদেশে বিদ্রোহ দমনে ছুটতে হলো অনতিবিলম্বে। তোগলকের নগর প্রাচীর রইল অসমাপ্ত। অবশেষে সুলতানের ফেরার সময় হলো। প্রমাদ গুনলেন নিজামউদ্দিনের অনুরাগীরা। তারা নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে অনতিবিলম্বে নগর ত্যাগ করে পালানোর পরামর্শ দিল। আউলিয়া মৃদু হেসে তাদের নিরস্ত করলেন—‘দিল্লি দূর অস্ত’, অর্থাৎ দিল্লি অনেক দূর।
এদিকে সুলতান প্রতিদিন যোজন পথ অতিক্রম করে নিকট থেকে নিকটবর্তী হচ্ছেন রাজধানীর পথে। প্রতিদিন ভক্তরা অনুনয় করে আউলিয়াকে। তিনি প্রতিদিন একই উত্তর দেন ‘দিল্লি দূর অস্ত।’ সুলতানের নগর প্রবেশের মাত্র একদিনের পথ অতিক্রমের অপেক্ষা। ব্যাকুল হয়ে শিষ্যরা অনুনয় করলেন আউলিয়াকে, ‘এখনো সময় আছে, এইবেলা পালান।’ গিয়াসউদ্দিনের ক্রোধ ও নিষ্ঠুরতার কথা কারও অজানা ছিল না। আউলিয়াকে হাতে পেলে কী দশা হবে তার, সে কথা কল্পনা করে ভয়ে শিউরে উঠল বারবার। মৃদু হেসে সেদিনও উত্তর দিলেন ভয়হীন আউলিয়া— ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।’ দিল্লি এখনো অনেক দূর। নগরপ্রান্তে সুলতানের জন্য অভ্যর্থনার আয়োজন করা হলো। স্থাপন করা হলো বিরাট মণ্ডপ। একটি হাতির শির সঞ্চালনে স্থানচ্যুত হলো একটি স্তম্ভ। মুহূর্তের মধ্যে শব্দে পতিত হলো সমগ্র মণ্ডপ। পরদিন ভোরে মণ্ডপের ভগ্ন স্তূপ সরিয়ে আবিষ্কৃত হলো বৃদ্ধ সুলতান এবং তার পুত্রের মৃতদেহ। দিল্লি রইল চিরকালের জন্য সুলতানের জীবিত পদক্ষেপে অতীত। অর্থাৎ ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।’
বছর ঘুরে রক্তস্নাত জুলাই মাস ফিরে এসেছে। এক বছর হতে চললেও জুলাই সনদ ঘোষণা ও সংস্কার—কোনোটিই এখনো হয়নি। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, জুলাই সনদ ও সংস্কার কি ‘হনুজ দূর অস্ত’ অর্থাৎ এখনো অনেক দূর? এদিকে শুরু হয়েছে ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণের পালা। আগামী ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের দিন পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। শুরু হয়েছে অভ্যুত্থানের এক বছরের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে নানা সমীকরণ। জুলাই সনদ প্রসঙ্গে বলতে হয়, মৌলিক বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও অনেক বিষয়ে এখনো মতভিন্নতা কাটেনি। মতভিন্নতা দূর করে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনীতির দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ চলছে। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সম্প্রতি জুলাই সনদ নিয়ে বলেছেন, ‘নানা বিষয়ে অগ্রগতি হলেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির জায়গা থেকে আমরা এখনো খানিকটা পিছিয়ে আছি।’ অর্থাৎ জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়া থেকে এখনো ‘দূর অস্ত’, এখনো দূরে অবস্থান করছে। কমিশনের সহসভাপতি এর আগে বলেছিলেন, ‘জুন মাসের মধ্যে কমিশন জাতীয় ঐকমত্যের একটি সনদে পৌঁছাতে চায়। প্রত্যাশা ছিল শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে সবাই মিলে এই সনদের স্বাক্ষর করতে পারব। সেটা হবে কি না, তা রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আমরা হয়তো সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। তারপরও বিশ্বাস, জুলাই মাসের মধ্যেই সংলাপের একটি পরিণতি টানা সম্ভব হবে।’ প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন সফরের সময় গত ১২ জুন এক সংলাপে বলেছিলেন, ‘জুলাই মাসে দেশের সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে জুলাই সনদ ঘোষণা করে তার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে।’ অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে জুলাই সনদ ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত বলাই যায়, ‘সনদ... দূর অস্ত।’
জুলাই সনদ বিষয়টি গণঅভ্যুত্থানের শুরুতে বা চলাকালে অথবা পরেও ছিল না। তাহলে বিষয়টি প্রথমে জুলাই ঘোষণাপত্র ও পরে জুলাই সনদ কীভাবে সামনে এলো এবং এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন নেতা ও ছাত্র উপদেষ্টা অনেকটা আকস্মিকভাবে সামাজিকমাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হওয়ার ঘোষণা দেন। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা জানান যে, ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’ ঘোষণা করা হবে। অভ্যুত্থানের নেতারা তখন গণঅভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। ছাত্রনেতারা একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগও দাবি করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই ‘প্রোক্লেমেশনের’ মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা এবং ১৯৭২ সালের ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর’ রচনার ঘোষণা দেয়। প্রধান উপদেষ্টা সে সময় বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ঘটনার পর থেকেই জুলাই ঘোষণার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার জুলাই সনদ ঘোষণার সময়সীমার কথা জানানো হলেও ওই সময়ের মধ্যে সরকার তা ঘোষণা করতে পারেনি। আইন উপদেষ্টা গত মে মাসে বলেছিলেন, জুন মাসের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা করা সম্ভব হবে। ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে বারবার জুলাই ঘোষণার দাবি জানানো হয়। সর্বশেষ জুলাই মাসের শুরু হওয়ার প্রাক্কালে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই সনদ দিতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২৯ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘সরকার যেহেতু বলেছিল, সবার সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ দেবে, তা হয়নি। সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এজন্য ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আগামী ৩ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ বর্তমান পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যার দরুন দ্বিতীয় পর্বে সাত দিন আলোচনা শেষেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে—সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, উচ্চকক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া, দায়িত্ব ও ভূমিকা, উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠিত হবে; এ নিয়েই বেশি মতবিরোধ চলছে। উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে অনেক দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির কথা বলেছে। তবে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এর স্পষ্ট বিরোধিতা করেছে। বিএনপি চায় সংসদে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। জামায়াত, এনসিপিসহ বাকি দলগুলো চাইছে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন। চার দিন ধরে এ বিষয়ে আলোচনা হলেও সমঝোতা হয়নি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও মতভিন্নতা রয়েছে। ২ জুলাই ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত সংস্কারের সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। গত ২০ মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেও এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে পারেনি।
জুলাই মাসে সবার দৃষ্টি জুলাই সনদের দিকে। বহুল প্রত্যাশিত এই সনদে কী থাকবে, ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী অথবা ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরুত্থানরোধ করতে জুলাই সনদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, তা জানার আগ্রহ সবার। নির্বাচন হবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে। আগামী বছরের শুরুতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা শুরু করবে—এমনটাই জনগণের প্রত্যাশা।
জুলাই সনদ নিয়ে সংলাপ চলমান থাকলেও অন্যান্য সংস্কার যেমন জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুদক, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও গণমাধ্যম সংস্কার নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। এর মধ্যে কোনো কোনো সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য উপদেষ্টাদের নিয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটি আবার কতদিন পর তার সুপারিশ তৈরি করবে, তা দেখার বিষয়। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, গণমাধ্যম কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তিন মাসেরও বেশি সময় পর পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব বিষয়ের সংস্কার নিয়ে সেই একই কথা বলতে হয়—সংস্কার... ‘হনুজ দূর অস্ত।’ সংস্কার... এখনো অনেক দূর।
লেখক: কলাম লেখক
মন্তব্য করুন