ড. দিলারা রহমান
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৯ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বর্ষা বিপ্লবে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প

বর্ষা বিপ্লবে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প

(গতকালের পর)

জুলাই-আগস্টের গণজাগরণে আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য সরকার প্রথম থেকেই অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। ১৮ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ত্যাগ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় অথচ এটি ছিল সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত। এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এরকম একটি বিক্ষোভ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামসুন নাহার হলের সানজিদার বক্তব্য ছিল হৃদয়গ্রাহী। ‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’—সানজিদার কাছে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছিল স্বাধীনতার আরেক নাম। মাই টিভিতে প্রচারিত এক ভিডিওতে তাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে দেখা যায়, ‘আমরা কেন হল ছাড়ব? আমরা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্টুডেন্ট। সরকার এখানে নাক গলাতেই পারে না। দে হাভ নো রাইট। উনাদের সতর্ক করছি, বাঘকে মাঠে নামাবেন না। রক্তে ভেসে যাবে। আপনারা নিজেরাই কোনো কূল-কিনারা পাবেন না। আমরা কেন হারব? আমরা তো কোনো অযৌক্তিক দাবি নিয়ে এখানে আসিনি, আমরা তো বলিনি কোটা বাতিল করেন। আমরা বলেছি সংস্কার করেন।’ তার মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি, যা অযৌক্তিক। তা ছাড়া অনেক সার্টিফিকেটধারী মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। আর এ সুযোগ গ্রহণ করছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। তার এ বক্তব্যে এটি সুস্পষ্ট যে, রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট বৈষম্যের প্রতি এ আন্দোলনে তিনি নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনা থেকে সম্পৃক্ত হয়েছেন। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মত বা নেতৃত্বের আহ্বান ছাড়াই তিনি তার আত্মোপলব্ধির জায়গা থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। মাই টিভির সে ভিডিওতে অভিভাবক হিসেবে একজন মায়ের সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়। তিনি পুলিশের কঠোর ভূমিকার সমালোচনা করেন। সরকারের মতপ্রকাশের অধিকার হরণের বিষয়ে তিনি কথা বলেন—‘আমি আমার বাচ্চাকে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছি, লাশ হতে নয়।’ এ নারীরা প্রত্যেকেই জানেন যে, মিডিয়ায় তাদের বক্তব্য এবং ছবি প্রচারিত হলে তারা ফোকাসড হবেন। সে কারণে তারা সরকারের রোষানলেও পড়তে পারেন। তবুও তারা আন্দোলনের সম্পৃক্ত হন এবং পরিষ্কারভাবে বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে চলা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য এবং একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য তারা তাদের ভাবনাকে তুলে ধরেছেন, যেখানে প্রত্যেকের অধিকার নিশ্চিত হবে।

‘নারী যেখানে অগ্রসর, কোটা সেখানে হাস্যকর’—চমৎকার এ বক্তব্যটি প্রচারিত হয়েছিল আন্দোলন চলা সময়ে ‘কোটা পেয়েও কেন আন্দোলনে নারীরা’ এ শিরোনামে এটিএন নিউজ চ্যানেলে। সেখানে বিভিন্ন নারীকে বলতে শোনা যায় যে, ‘আমরা নারী, আমরাও পারি। এটা আমরা প্রমাণ করতে চাই। নারী বলে আমাদের চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোটা দিতে হবে, এটা অবমাননাকর। কোটা থাকতে পারে, তবে তা প্রতিবন্ধী বা অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য। অনগ্রসর বলে আমাদের মেধাকে হেয় করা হচ্ছে। কোটা নয় বরং মেধা দিয়ে নারীকে মূল্যায়ন করা হোক।’ এটিএন নিউজ চ্যানেলের ভিডিওটি থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, নারীরা নিজেদের মেধা ও শক্তির প্রতি এখন অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল। তারা নিজেরা এখন আর অবহেলিত এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ভাবে না।

বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে চলা আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এ গণজাগরণে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবী মহিলাদেরও অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। ১ সেপ্টেম্বর বিবিসি নিউজ বাংলায় প্রকাশিত আকবর হোসেনের ‘শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে এত নারী রাস্তায় নেমেছিল কেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পেশাদার বডিবিল্ডার ফারজানা লিওর বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ফারজানা লিও বলেন, ‘আমি মনে করেছি যে, রাস্তায় গিয়ে আন্দোলন করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের ছেলেদের রক্ষা করতে হবে, এটা আমি ভেবেছিলাম। মায়ের দিক থেকে যখন আপনি সাপোর্ট পাবেন, তখন সন্তান বলেন আর সহকর্মী বলেন, সবারই বুকের সিনা টান হয়ে যায়। মা যদি সাহস দেয় যে, তুমি যাও। তুমি না গেলে দেশের কী হবে? তুমি না গেলে এই দেশকে কে রক্ষা করবে? এ সাহসটা তো ঘর থেকে আসতে হবে।’ ফারজানা লিওয়ের এ বক্তব্য যদি আমরা মূল্যায়ন করি তাহলে দেখতে পাই যে, ওনার মতো বহু নারী স্বেচ্ছায় এ আন্দোলনে এসেছেন। পুলিশ যেভাবে কঠোর হয়ে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের হত্যা করেছে এবং আহত করেছে, এটা তারা মা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। সন্তানদের উৎসাহ দিতে, সাহস জোগানোর নৈতিক জায়াগা থেকে তারা এ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। মায়েদের তাদের সন্তানদের স্বেচ্ছায় এ আন্দোলনে শরিক হওয়ার উৎসাহ জোগানোর কারণে এবারের আন্দোলনে পুলিশের কঠোর ভূমিকাও আন্দোলনকারীদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। পুলিশকে তাইতো বলতে শোনা যায়, ‘মারি একটা, মরে একটা, বাকিডি যায় না। এটাই সমস্যা।’ মায়েদের সাহসিকতার সঙ্গে সন্তানদের এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার উৎসাহ দেওয়ার মানসিকতা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের ভূমিকা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে প্রমাণ করে।

একটি ভিডিওতে ৩১ জুলাইয়ের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি চলাকালে হাইকোর্টের মাজারগেটে, ‘পিঠে ব্যাকপ্যাক ও চশমা পরা’ একটি মেয়েকে (নুসরাত জাহান টুম্পা) পুলিশের প্রিজন ভ্যান আটকে দিয়ে বলতে শোনা গেছে—‘আমি আমার ভাইকে নিয়ে যেতে দেব না।’ এর কিছুক্ষণ আগে ভিডিওটিতে দেখা যায়, পুলিশ মেয়েটির সঙ্গে থাকা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাইকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে উঠিয়েছিল। এ ঘটনার প্রতিবাদে মেয়েটিকে তার সর্বশক্তি দিয়ে প্রিজন ভ্যানের গতিরোধ করতে দেখা যায়। পুলিশের অস্ত্রের কাছে নতিস্বীকার না করে মেয়েটির দৃঢ়চিত্তে প্রতিবাদের এ ভিডিও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেইসঙ্গে এটিও প্রমাণ করেছে যে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা আন্দোলন দমাতে সরকার কতটা মরিয়া হয়েছিল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন-পরবর্তী সময়ে নাগরিক টিভিতে ‘আসছে ফাগুন, আমরা হব দ্বিগুণ’—এ শিরোনামে নুসরাত টুম্পার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। এ পুরো সাক্ষাৎকারটি তার সঙ্গে থাকা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাই নুরকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করার দৃঢ় মানসিক শক্তি, পুরুষের পাশাপাশি নারীও যেকোনো কাজে যে সমান পারদর্শী; তারই ইঙ্গিত বহন করে।

আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রীদের নিয়ে একটি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করা হয়। সেখানে আটজন ছাত্রী আন্দোলন সম্পর্কে এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলাখুলিভাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। তারা জানান, ১৭ জুলাই রাতে যখন হল ছাড়ার নির্দেশ আসে, তখন তারা সংঘবদ্ধভাবে হল না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ছাত্রী হল রয়েছে। তিনটি হলের মেয়েরাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন এবং ছেলেদের সঙ্গে এক হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হন। তারা আরও জানান, এমনকি ১৪ তারিখ রাতে মেয়েরা ছেলেদের আগেই মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৮ জুলাই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপে হল ছাড়তে বাধ্য হন। এ ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনে সবাই একটি কথা বলেছেন, কোটা সংস্কারের জন্য আগে থেকেই তারা সোচ্চার ছিলেন। তবে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’ সম্পর্কিত কটূক্তি তাদের ভীষণ মর্মাহত করে। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু তাদের যারপরনাই ব্যথিত করে এবং সাহস বাড়িয়ে দেয়। নারী হিসেবে নিজেদের কখনো তারা আলাদা কিছু ভাবেননি। সে কারণে ১০ শতাংশ নারী কোটা দিয়ে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বিষয়টি তারা তাদের মেধার প্রতি অসম্মানজনক বলে মনে করেন। কয়েকজন ছাত্রী এ কথা বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকার যেভাবে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছিল, টাকা পাচার ও দুর্নীতির মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল; এ বিষয়গুলো তাদের মধ্যে ক্ষোভ জমিয়েছে। [চলবে]

লেখক: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অভাব-অনটন থেকে মুক্তি মিলবে যে দোয়ায়

ফিরে এসেই জাংকুকের বাজিমাত

ভারতে ২৮ বাংলাদেশিকে দুই বছর কারাদণ্ড

ডাকসুর ভোটকেন্দ্র ৬ জায়গায়

হাতের নখ বড় রাখা নিয়ে যা বলছে ইসলাম

সীমান্তে বিএসএফের হাতে আটক তিন বাংলাদেশি চোরাকারবারি : বিজিবি

গুগল ক্রোম ও এজ ব্যবহারকারীদের জন্য ‘রেড অ্যালার্ট’ পরিস্থিতি

ম্যানচেস্টার টেস্টের আগে ভারতীয় শিবিরে বড় ধাক্কা

ঋণের চাপে নিজেকে শেষ করলেন যুবক

জুলাই হত্যাকাণ্ড: সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ৩৯ জন ট্রাইব্যুনালে

১০

বাতিল ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ, ক্ষমা চাইল আয়োজকরা

১১

মারা গেলেন অস্কারজয়ী গীতিকার অ্যালান বার্গম্যান

১২

আইএফআইসি ব্যাংকে টিএসও পদে নিয়োগ শুরু

১৩

গ্রামবাংলার জনপ্রিয় হাডুডু খেলা দেখতে জনতার ঢল

১৪

প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানালেন জামায়াত আমির

১৫

টেবিলে বই খোঁজার সময় শিশুর কপালে সাপের কামড়

১৬

মেসির জোড়া গোল ও অ্যাসিস্টে ইন্টার মায়ামির বড় জয়

১৭

গৃহকর্মীদের কোটি টাকার উপহার দিলেন আলিয়া!

১৮

২০ জুলাই : আজকের রাশিফলে কী আছে জেনে নিন

১৯

হঠাৎ মার্কেট আউট পালসার এন১৫০

২০
X