মোতাহার হোসেন
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জীবন টিকে থাকে জলে

জীবন টিকে থাকে জলে

জলের সঙ্গে জীবনের, জলের সঙ্গে অর্থনীতির, জলের সঙ্গে সভ্যতার, জলের সঙ্গে পর্যটনের, জলের সঙ্গে যোগাযোগের, জলের সঙ্গে নগর-মহানগরের, জলের সঙ্গে খনিজ এবং মৎস্য ও জলজ সম্পদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এক কথায় মানুষের জীবনে, মরণে এমনকি মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে আছে সাগর, মহাসাগর, নদনদী প্রভৃতি। পৃথিবীর এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সাগর পথে যোগাযোগের, ব্যবসা এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম বাহন হিসেবে ব্যবহার হয়। আবার জলের অন্য নাম জীবন হলেও জলদূষণ তথা পানি দূষণ, সমুদ্র দূষণ অব্যাহত রয়েছে। এই দূষণ স্থানীয়, আঞ্চলিক এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিস্তৃতি। এ বাস্তব সত্য স্থানীয়, আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক এমনকি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে খুব সামান্যই গুরুত্ব পায়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সমুদ্র সম্পদ, সমুদ্র দূষণ, সমুদ্র রক্ষায় তথায় পৃথিবীকে জালের মতো জড়িয়ে রাখা, পৃথিবীকে আগলে রাখা সাগর-মহাসাগরকে নিয়ে স্থানীয়, আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক এমনকি বৈশ্বিক তথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কার্যকর আলোচনার উদ্যোগ প্রত্যক্ষ হয় না।

কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমুদ্রের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে বাতাসে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে পৃথিবী নামক এই গ্রহের উষ্ণতা বাড়লে তখন ‘পৃথিবীর তাপমাত্রা’ সীমিত রাখতে সমুদ্র এক বিশাল কার্বন শোষক ও তাপ ধারক হিসেবে কাজ করে থাকে। বিশ্বের কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং এই নিঃসরণ থেকে সৃষ্ট ৯০ শতাংশ অতিরিক্ত তাপ ধারণ করে সমুদ্র আমাদের গ্রহকে এক ভয়ংকর বিপর্যয় থেকে রক্ষা করছে। অথচ জলবায়ু আলোচনায় সমুদ্র চিরকালই অবহেলিত এক প্রান্তিক চরিত্রে রয়ে গেছে।

অতি সম্প্রতি ফ্রান্সের নিস শহরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলন (UNOC3)-এ এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে আলোচনায় আসে। সম্মেলনে অভিযাত্রী, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য এবং বিশেষজ্ঞরা সমুদ্রকে জলবায়ু আলোচনার মূলধারায় আনার জন্য জোর দাবি জানান। কারণ, অতিরিক্ত কার্বন শোষণের ফলে সমুদ্র অ্যাসিডিফিকেশনে ভুগছে, এর তাপমাত্রার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্য, মৎস্য সম্পদ এবং পৃথিবীর দেশে দেশে সমুদ্র উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর ওপর। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, ‘পৃথিবী জ্বলছে, সমুদ্র ফুটছে।’ তিনি বিশ্বনেতাদের এক ‘অভূতপূর্ব সমবেত উদ্যোগ’ হিসেবে সমুদ্র রক্ষার বিষয়টি জলবায়ু আলোচনায় জরুরি ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। ১২০টি দেশ, ৫০ জন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রায় ১০ হাজার অংশগ্রহণকারী এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

আগামী নভেম্বরে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য COP৩০ জলবায়ু সম্মেলনের প্রাক্কালে সমুদ্রকে আলোচনায় আনার বিষয়ে UNOC3 গুরুত্বপূর্ণ এক মঞ্চে পরিণত হয়। অথচ, জলবায়ুবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ‘প্যারিস চুক্তি’তেও সমুদ্রের উল্লেখ একেবারেরই সামান্য। সমুদ্রবিষয়ক সংগঠন Oceano Ayul Foundation-এর লুইস ল্যামব্রেখটস সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা UNOC3-এ এসেছি, আর জলবায়ু COP চলছে COP৩০-এ। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে সমুদ্র জলবায়ু আলোচনায় স্থান পায়নি।’ সমুদ্রের জলবায়ু নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা বিশেষ করে এর বিশাল কার্বন শোষণ ক্ষমতাকে গুরুত্ব দিয়ে ল্যামব্রেখটস বলেন, ‘জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য ও সমুদ্র নীতিকে একই ধারায় এনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারলে আমাদের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।’ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গ্রিন দলের একজন সদস্য বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি সমুদ্রকে জলবায়ু আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে লড়েছেন। তার মতে, ‘মানুষের মনোযোগ থাকে স্থল, বন, বায়ুমণ্ডল বা হিমবাহ অঞ্চলের দিকে। অথচ সমুদ্রও জলবায়ুর অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক।’ এই বাস্তবতা আমরা অনেকেই বেমালুম ভুলে যাই।’

বিশ্ববাসীর জন্য দুঃসংবাদ হলো এ সম্মেলনেও যথারীতি অনুপস্থিত রইল যুক্তরাষ্ট্র। এ গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে অনুপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন প্যারিস চুক্তি থেকে সরে এসে এখন একতরফাভাবে গভীর সমুদ্র খননে এগোচ্ছে। সুইডেনের পরিবেশবিদ ল্যাভিন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি লজ্জাজনক। এ সংকটময় সময়ে বিশ্বনেতাদের একত্রিত হয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবী রক্ষা করা জরুরি।’ মানবজাতির এমনি এক সংকটকালেও ‘সমুদ্র কিন্তু কোনো নিঃশব্দ দর্শক নয়, এটি জলবায়ু যুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা।’

প্রত্যাশা থাকবে জলের গুরুত্ব তথা পৃথিবীকে জালের মতো আগলে রাখা নদনদী, সাগর, মহাসাগরকে রক্ষায় লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে অনুষ্ঠেয় আগামী COP৩০ হোক বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ঐক্যবদ্ধ এবং কার্যকর প্রয়াস এবং এ বারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন এমন এক সুযোগ বয়ে আনবে যেখানে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মুখে সমুদ্রের কণ্ঠস্বর আরও উচ্চ স্বরে শোনা যাবে। যদি নদনদী, সাগর, মহাসাগর তথা সমুদ্র রক্ষায় বিশ্বের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ এবং দুর্বল অথবা উপেক্ষিত হয়, তাহলে বিশ্বের নদনদী, সাগর-মহাসাগর একসময়ে সরবে, নীরবে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ধীরে ধীরে মানব জাতির ওপর প্রতিশোধ নেবে, নিতে বাধ্য হবে—এটিই চিরন্তন সত্য। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যার মতো নানারকম দুর্যোগ মানুষকে, পৃথিবী নামক গ্রহকে বিপর্যয়ের দিকে তথা হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। নিশ্চয় এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ কারোর জন্য কাম্য নয়।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কারাগারে বিক্রমাসিংহে, মুখ খুললেন সাবেক তিন প্রেসিডেন্ট

গোল্ডেন হারভেস্টে বড় নিয়োগ

যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন ভিসার ফি বাড়ছে দ্বিগুণের বেশি

জুম টিভির অফিসে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান

ধেয়ে আসছে শক্তিশালী ঝড়, ৬ লাখ মানুষকে সরানোর নির্দেশ 

হাসপাতালে বাণিজ্যিক নার্সারি, সন্ধ্যায় বসে মাদকসেবীদের আড্ডা

ইহুদিবিদ্বেষ ইস্যুতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করল ফ্রান্স

টিভিতে আজকের খেলা

এমবাপ্পের জোড়া গোলে লা লিগায় রিয়ালের সহজ জয়

ইবনে সিনায় চাকরির সুযোগ

১০

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১১

জেনে নিন আজকের নামাজের সময়সূচি

১২

এলোপাতাড়ি কুপিয়ে স্ত্রীকে হত্যা

১৩

ক্যাশমেমো নেই, খুচরা বাজারে দ্বিগুণ দাম কাঁচামালে

১৪

রামপুরায় ভবনের ৬ তলা থেকে পড়ে রডমিস্ত্রির মৃত্যু

১৫

কুড়িয়ে পাওয়া ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ফেরত দিলেন ভ্যানচালক

১৬

বুড়িগঙ্গা থেকে লাশ উদ্ধার / ৪ জনকেই হত্যা করা হয়েছে, ধারণা পুলিশের

১৭

ওসির বদলির খবরে মোহাম্মদপুর থানার সামনে মিষ্টি বিতরণ স্থানীয়দের

১৮

বিএনপি নেতা আব্দুস সালামের চিকিৎসার খোঁজ নিলেন ডা. কাঁকন 

১৯

সিপিএলে ইতিহাস গড়ে ফ্যালকনসকে জেতালেন সাকিব

২০
X