ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ড. ইউনূসকে কীভাবে মনে রাখবে জাতি

ড. ইউনূসকে কীভাবে মনে রাখবে জাতি

১৯৪০ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহণকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের এক গর্বিত সন্তান, যিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার জনক এবং বৈশ্বিক মাইক্রোক্রেডিট বিপ্লবের পথিকৃৎ। তার অনন্য অবদানের ফলে তিনি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং সারা বিশ্বে এক সম্মানিত নাম হিসেবে পরিচিত। তিনি জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

বিশ্বের ইতিহাসে তিনি বিরল সেই সাতজন ব্যক্তির অন্যতম, যিনি একসঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ এবং ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল’—এ তিনটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেছেন। ২০১২ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিযুক্ত হন এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশ তার অভিজ্ঞতা, সুনাম ও বৈশ্বিক সংযোগকে দেশের উন্নয়নে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। যদি তাকে বাংলাদেশের একজন বিশ্বদূত বা উন্নয়ন-দূত হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হতো, তবে তিনি হয়তো বাংলাদেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতেন।

আরও দুঃখজনক বিষয়, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে তাকে পরিকল্পিতভাবে হেনস্তা করার নানা কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। একসময় তাকে প্রায় জনজীবন ও অর্থনৈতিক পরিসর থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। এমনকি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল না ঘটলে, তাকে হয়তো তার শেষ জীবনটা কারাগারেই কাটাতে হতো—এমন আশঙ্কাও অমূলক ছিল না।

দেশের চরম সংকটকালে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই মুহূর্তটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও একটি বিরল ও অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

বিশ্বে বহু রাষ্ট্রনায়ক আছেন যারা ক্ষমতায় থাকাকালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছেন। কিন্তু নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর, বিশেষ করে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার প্রায় দুই দশক পর—একজন ব্যক্তি কোনো দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী নেতৃত্বে আসার নজির বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। এই নতুন পরিচয় ও দায়িত্ব গ্রহণ যেমন ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত জীবনে এক অসামান্য মাইলফলক, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসেও তা এক যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে থাকবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাসনির্ভর বিশ্লেষণগুলো হয়তো এ সিদ্ধান্তকে এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের ঘটনা হিসেবেও বিবেচনা করবে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, সরকারপ্রধান হিসেবে জনগণ ভবিষ্যতে তাকে কীভাবে মনে রাখবে?

আগামী ৮ আগস্ট তার শাসনামলের এক বছর পূর্ণ হবে। এই এক বছরে তিনি জাতিকে এক গভীর সংকট থেকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কঠিন মোকাবিলা করেছেন এবং এখনো সেগুলোর বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। অর্থনীতিকে গভীর স্থবিরতা থেকে উত্তোলনের লক্ষ্যে তিনি একটি সমন্বিত পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং নাগরিক আস্থার পুনর্গঠন। তার নেতৃত্বে এ স্বল্প সময়েই দেশে নীতিগত স্থিতিশীলতা ফিরেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক ভিত্তি রচনা করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার তার শাসনকালেই একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, সংবিধান ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতে কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাবনা। এসব কমিশন এরই মধ্যে তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। একই সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সংলাপ ও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য ও সুশৃঙ্খল নির্বাচনের ভিত্তি রচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভবত নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যা এ সরকারের অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এ সাফল্যগুলো হয়তো সময়ের বিবর্তনে মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে পারে কিংবা ইতিহাসে তা শুধু আনুষ্ঠানিক উল্লেখমাত্র হয়ে থাকবে। কারণ, এগুলো শুধু একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ—প্রত্যাশিত, কিন্তু স্মরণীয় নয়।

তবে এ সরকারের সামনে এমন কিছু ঐতিহাসিক সুযোগ ছিল, যেগুলোর সদ্ব্যবহার করলে তা শুধু সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামোগত রূপান্তর সাধনে অনুঘটকের কাজ করতে পারত। জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনিক জবাবদিহির মতো ক্ষেত্রগুলোতে সাহসী, জনমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ এ সরকার পেয়েছিল। তা ছাড়া, বেশিসংখ্যক মানুষকে করের আওতায় আনতে কর কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন এবং আর্থিক বছর জুলাই-জুনের পরিবর্তে জানুয়ারি-ডিসেম্বরে রূপান্তর করার সুযোগও ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব সুযোগ অনেকাংশেই অননুধাবন, দ্বিধা অথবা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবু এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ রয়ে গেছে—যেগুলো গ্রহণ করলে বর্তমান সরকার, বিশেষ করে এর প্রধান, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ইতিহাসে শুধু একটি অতিবাহিত প্রশাসনের প্রধান হিসেবে নয়, বরং এক গভীর সংকটে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত একজন রূপান্তরকামী নেতা হিসেবে স্থান পেতে পারেন। সব পরিবারের জন্য বছরে ন্যূনতম এক লাখ টাকার সুবিধা সংবলিত পারিবারিক স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন, স্থায়ী স্বাস্থ্য কমিশন ও ‘বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস’ গঠনের মতো নীতিগত কাঠামো প্রবর্তন এবং শিক্ষা সংস্কারের বাস্তবায়ন কাঠামো তৈরি—এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার নাম জনগণের মনে দীর্ঘস্থায়ীভাবে অম্লান হয়ে থাকতে পারে।

উল্লেখ্য, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বৈরশাসক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হলেও তিনি দেশের স্বাস্থ্য খাতে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখে গেছেন। দেশি-বিদেশি নানা চাপ ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তিনি ১৯৮২ সালে ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ প্রণয়ন করেন, যা ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ভিত্তি মজবুত করেন এবং স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক উপাদান সুলভমূল্যে জনগণের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এ অর্জন তাকে ইতিহাসে একটি স্থায়ী আসন করে দিয়েছে।

তাই মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ—আপনি এমন একটি পদক্ষেপ নিন, যা আপনাকে সরকারপ্রধান হিসেবে জনগণের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। বর্তমান রূপান্তরকালীন দেশের স্বাস্থ্য খাতকে মৌলিক সংস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হলে সেটি হবে সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। কেননা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কোনো মৌলিক পরিবর্তনের সুফল প্রত্যক্ষভাবে জাতির প্রতিটি মানুষ পায়, তা সে শহরের হোক কিংবা গ্রামের।

এই প্রেক্ষাপটে আমরা সুপারিশ করছি—আপনি সব পরিবারের জন্য বছরে কমপক্ষে এক লাখ টাকার স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা দিয়ে একটি ‘জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য কার্ড’ চালু করুন। এই উদ্যোগ শুধু জনকল্যাণেই নয়, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণের ভিত্তিও সুদৃঢ় করবে। এই কার্ড চালুর জন্য বিশাল অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ বা জটিল আইনি সংস্কারের প্রয়োজন নেই। দেশের প্রচলিত আইনকানুন এবং বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মধ্যেই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট বরাদ্দ রয়েছে, তার সঙ্গে সামান্য অতিরিক্ত বরাদ্দ সংযুক্ত করলেই এ পদক্ষেপ চালু করা যায়।

এ সিদ্ধান্ত একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে, যা আপনাকে শুধু বর্তমান প্রশাসনের প্রধান হিসেবেই নয়, ইতিহাসে একজন জনমুখী ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্মরণীয় করে রাখবে।

লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাদ্রাসায় চালু হলো নতুন সাবজেক্ট

মুরাদনগরে বিষাক্ত স্পিরিট পানে ২ জনের মৃত্যু

প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, থানায় মামলা

কুষ্টিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ভোমরারা হতাশ হয়েছেন : নুর

দেশে ফিরলেন প্রধান উপদেষ্টা

এবার চট্টগ্রামে সাংবাদিককে গলা টিপে হত্যাচেষ্টা

সাবেক ৩ গভর্নর ও ৬ ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব

এনসিপির হয়ে নির্বাচন করব কিনা সিদ্ধান্ত নেইনি : আসিফ মাহমুদ

সবাইকে টেস্ট খেলানো জরুরি নয় : জোরাজুরিতে দেউলিয়ার শঙ্কা

১০

প্রবাসেও আপ বাংলাদেশের কমিটি ঘোষণা 

১১

ইসরায়েল পুড়ছে রেকর্ড তাপমাত্রায়

১২

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে আর্থিক সহায়তার চেক দিল যমুনা অয়েল

১৩

অসহায় পরিবারের দুই শিশুকে চিকিৎসা সহায়তা-অটোরিকশা দিলেন তারেক রহমান

১৪

৩০০ আসনে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে গণতন্ত্র মঞ্চ 

১৫

ড্রোন শো পরিচালনার প্রশিক্ষণে চীন যাচ্ছেন ১১ জন

১৬

সামাজিক কাজে অবদান রাখায় নিবন্ধন পেল প্রভাত

১৭

স্বাস্থ্যের ডিজির আশ্বাসে মন গলেনি, নতুন কর্মসূচি ছাত্র-জনতার

১৮

শহীদ মিনারে কাফনের কাপড় পরে বস্তিবাসীদের অবস্থান

১৯

পিআর পদ্ধতিতেই নির্বাচন হতে হবে : চরমোনাইর পীর

২০
X