সীমানা বিরোধ শুধু ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে নয় বরং এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, স্মৃতির রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হলো, প্রাচীন খমের-হিন্দু মন্দির প্রাসাত তা মুয়েন থমের কাছে। এই সহিংসতা আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল, অমীমাংসিত অতীত বারবার বর্তমানকে রক্তাক্ত করে।
ঘটনার সূত্রপাত হয় একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে, যেখানে থাই সেনারা আহত হয়। এরপর থাইল্যান্ড বিতর্কিত সীমান্ত অংশে কাঁটাতারের বেড়া বসায় আর কম্বোডিয়া একে সরাসরি উসকানি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। কূটনৈতিক বার্তায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে—দুই দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানো হয়, সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেনা মোতায়েন বাড়তে থাকে। এর পরিণতিও ছিল অনিবার্য। তোপের গোলা, রকেট হামলা, বিমান থেকে বোমাবর্ষণ, আর মাঝখানে অসহায় সাধারণ মানুষ। থাইল্যান্ডের ১১ জন বেসামরিক নাগরিক ও একজন সেনা নিহত হয়েছেন। কম্বোডিয়ার ছোড়া রকেটে গ্রামগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়েছে। পাল্টা হিসেবে থাইল্যান্ড এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থেকে হামলা চালিয়েছে। নমপেন দাবি করছে, তারা শুধু আত্মরক্ষার জন্য লড়ছে। আর ব্যাংকক বলছে, হামলার সূচনা কম্বোডিয়ার দিক থেকেই হয়েছে। গল্পের কাঠামো পুরোনো, শুধু ভুক্তভোগীরা নতুন। এটি বিচ্ছিন্ন কোনো সংঘর্ষ নয়। গত মে মাসেও সীমান্তে সংঘর্ষ হয়েছিল, তখন গোপন আলোচনার মাধ্যমে তা সাময়িকভাবে থেমেছিল। এবার সহিংসতা আরও তীব্র, কারণ এবার বিমানবাহিনীও যুক্ত হয়েছে। এটি প্রমাণ করছে, দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক বহু বছরের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে।
এ বিরোধের মূল শিকড় ঔপনিবেশিক যুগের মানচিত্রে। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তরেখা তাদের হাতে নয়, ফরাসি ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এঁকেছিল। ফলে রয়ে গেছে অস্পষ্টতা, যা আজ বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ছে। কম্বোডিয়াবাসীর কাছে তা মুয়েন থম বা প্রাহ ভিহিয়ার মতো মন্দির শুধু স্থাপত্য নয়, এটি অ্যাঙ্গোকোরীয় সভ্যতার গৌরবময় স্মারক। থাইদের কাছে এগুলো এমন এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যেটি তারা একসময় প্রভাবিত হয়েছিল। তাই ইতিহাসকে দুই দেশই নিজেদের অহংকার আর ক্ষোভের দৃষ্টিতে দেখে। সমঝোতা মানে বিশ্বাসঘাতকতা, ছাড় দেওয়া মানে জাতীয়তাবাদের ক্ষোভ ডেকে আনা। ইতিহাস এখানে ভয়ংকরভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ২০১১ সালে প্রাহ ভিহিয়ার মন্দির ঘিরেও একইরকম সংঘর্ষ হয়েছিল, তখন ২৮ জন মারা গিয়েছিল আর হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল। তখন আসিয়ান (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংগঠন) কিছুটা মধ্যস্থতা করে পরিস্থিতি শান্ত করতে পেরেছিল। কিন্তু আজকের আসিয়ান দুর্বল। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, দক্ষিণ চীন সাগর বিরোধ আর যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যস্ত সংগঠনটি আর আগের মতো সক্রিয়ভাবে সংকট সামলাতে পারছে না। ঝুঁকি বেড়েছে, কিন্তু মীমাংসার ক্ষমতা কমেছে।
এ সংঘাত শুধু কয়েক কিলোমিটার জঙ্গলের জন্য নয়, এর প্রভাব গোটা অঞ্চলের জন্য ভয়াবহ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তার আধুনিক পরিচয় গড়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আপেক্ষিক শান্তির ভিত্তিতে। দুই আসিয়ান সদস্যের মধ্যে সীমান্তযুদ্ধ সেই ভাবমূর্তিকে ভেঙে দিতে পারে। এটি আবার প্রমাণ করছে—‘আসিয়ান ওয়ে’ বা আপস, সংযম ও অন্তহীন আলোচনার পথ কতটা সীমিত। যদি সহিংসতা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে দুই দেশই নিজেদের প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াবে, যা নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারে। সীমান্তের সাধারণ মানুষের জীবন, যাদের বাণিজ্য ও পর্যটনের ওপর নির্ভর করে, যা একদম থমকে যাবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন