মিতা রহমান
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রতিটি স্তরেই মমতাময়ী নারীদের প্রতিবাদী অংশগ্রহণ ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ছত্রছায়ায় ‘অসীম শক্তিধর’ আওয়ামী সন্ত্রাসী, বেপরোয়া র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর তাক করা অস্ত্র-গুলির সামনে তেজোদীপ্ত-সাহসী নারীরা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের প্রতিবাদ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য টনিক হিসেবে কাজ করেছিল। তারা সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়ান অকুতোভয় সৈনিকের মতো। ৩৬ দিনের আন্দোলনে এসব সাহসী বীর নারীর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে দেশ থেকে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসন চিরতরে মুছে দিতে জীবনবাজি রেখে রাত-দিন রাজপথে ছিলেন আমাদের দেশের সংগ্রামী নারীসমাজ। আন্দোলন-সংগ্রামে পাবলিক ও প্রাইভেট—সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কেউ নারী বা পুরুষ পরিচয় নিয়ে তখন মাঠে নামেননি। মাঠে নেমেছিলেন দীর্ঘদিন জাতির ঘাড়ে বসে থাকা ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের লক্ষ্যে। সবাই ভেবেছিলেন, একটা দেশের সরকার কীভাবে তার নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করছিল। তাইতো তারা তাদের ভাই, বাবার এমনকি সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য রাজপথে নেমে এসেছিলেন।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায় হলেও নারী তাদের হিস্যা বুঝে পাননি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রগুলো নারীরা এখনো বৈষম্যের শিকার। নতুন বাংলাদেশে নারীর প্রতি আরও সহনশীল হওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা এখনো হয়নি। সরকার ও দেশের সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই বাংলাদেশে শুধু নারী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে। সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে, ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে ‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’। সাহসী শিক্ষার্থী সানজিদা চৌধুরীর অগ্নিঝরা এ বাক্যটি শক্তি জুগিয়েছে আন্দোলনকারীদের। একটা চরম বার্তা পেয়েছিল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান, সব আন্দোলন-সংগ্রামে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালনের পাশাপাশি নেতৃত্বও দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই অভ্যুত্থান শেষে নারীদের পিছিয়ে দেওয়া হয়, অবমূল্যায়ন করা হয়। রাষ্ট্রও নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেয় না; অধিকারের প্রশ্নে নীরব থাকে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী আহত হয়েছেন। উত্তরায় বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ নাঈমা সুলতানার (১৫) মা আইনুন নাহার, প্রবীণ নারী মাসুরা বেগম, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শামীমা সুলতানা, শ্রমজীবী নারী সামিনা ইয়াসমিন, নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিন, ‘চব্বিশের উত্তরা’ সংগঠনের প্রতিনিধি সামিয়া রহমান প্রমুখ। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৩২ শিশু-কিশোর এবং ১১ জন নারী শহীদ হয়েছেন। তথ্য বলছে, শহীদ ১১ নারীর মধ্যে রয়েছেন মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেছা, লিজা, রিতা আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়া, নাছিমা আক্তার, রিয়া গোপ, কোহিনূর বেগম, সুমাইয়া আক্তার, মোসা. আক্তার ও নাঈমা সুলতানা। প্রশ্ন, রাষ্ট্র কি তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করেছে, যথাযথ সম্মান কি তারা রাষ্ট্রের কাছে, রাষ্ট্রের জনগণের কাছে পেতে পারেন না?

৫ আগস্টের পর থেকে গোটা আন্দোলন নিয়ে এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যে মেয়েরা স্লোগানে-বিক্ষোভে-প্রতিবাদে রাজপথ মুখর করে রেখেছিলেন, যাদের ছাড়া এই আন্দোলন কখনোই সফল হতো না বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা, এখন সেই মেয়েদের হারিয়ে যেতে দেখছি আমরা। নারীর অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সংস্কার পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। দেখা যাচ্ছে আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়ার পরও অধিকার আদায়ের বেলায় মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছেন ক্রমাগত। ক্রমাগত যেন চলে যাচ্ছে দৃশ্যের বাইরে।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই তাদের অবদান অস্বীকার করা হয় এবং তাদের পিছিয়ে দেওয়া হয়। ১৪ জুলাইকে ‘জুলাই উইমেন্স ডে’ পালন করা হলো। এগুলো করা যেতে পারে। কিন্তু তাদের স্বীকৃতি না দিয়ে, মর্যাদা না দিয়ে, নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এসব উৎসব পালন, ড্রোন ওড়ানোর কোনো মানে হয় না। অভ্যুত্থানের চেতনা পরিপন্থি কাজ এখন হচ্ছে। এই সরকারের প্রথম কাজ ছিল সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেটা করতে তারা ব্যর্থ।

অভ্যুত্থান হয়েছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কিন্তু এখন তার বিপরীত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। নারীর প্রতিটি প্রাপ্তিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে রাষ্ট্র নীরব ভূমিকা পালন করছে। মনে রাখতে হবে, নারীরা হারিয়ে যাননি। তারা ইতিহাসের প্রয়োজনে আবার হয়তো মাঠে নেমে আসবেন। শাসকগোষ্ঠী তাদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে না চাইলেও ইতিহাস তাদের মনে রাখবে।

লেখক: আহ্বায়ক, জাতীয় নারী আন্দোলন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২০১৮ সালের নির্বাচনের বদনাম ঘোচাতে চায় পুলিশ : ডিএমপি কমিশনার

ওয়েস্ট হ্যামের বিরুদ্ধে চেলসির বড় জয়

নরসিংদী জেলা সাংবাদিক সমিতি, ঢাকা’র নতুন কমিটিকে সংবর্ধনা

কেইনের হ্যাটট্রিকে লেইপজিগকে উড়িয়ে দিল বায়ার্ন

নিখোঁজের একদিন পর যুবকের মরদেহ মিলল পুকুরে

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন ট্রাম্প

এশিয়া কাপ দলে জায়গা পেয়ে সোহানের কৃতজ্ঞতার বার্তা

ঘুষ কেলেঙ্কারিতে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার

প্রবীণদের বিশেষ যত্ন নিয়ে বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিন: স্বাস্থ্য সচিব

বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত: রাষ্ট্রদূত আনসারী

১০

লা লিগার কাছে যে অনুরোধ করতে চায় বার্সা

১১

‘নির্বাচনে আমলাদেরকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে’

১২

সাবেক এডিসি শচীন মৌলিক কারাগারে

১৩

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা আসছেন শনিবার, যেসব বিষয়ে আলোচনা

১৪

সিদ্ধিরগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের শানে রিসালাত সম্মেলন

১৫

শেষ দিনেও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে মতামত দেয়নি ৭ রাজনৈতিক দল

১৬

ইউরোপের লিগগুলোতে দল কমানোর প্রস্তাব ব্রাজিল কোচ আনচেলত্তির

১৭

নেপালে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের প্রচার, তাসনিম জারার ব্যাখ্যা

১৮

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে মৃত্যুর মিছিল, তিন বছরে প্রাণ হারান ১৮৩ জন

১৯

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি 

২০
X