কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বৈরশাসন জনগণের কাছে পরাজিত হয়

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
স্বৈরশাসন জনগণের কাছে পরাজিত হয়

দীর্ঘ শাসনে সবাইকে খেপিয়ে তুলেছিলেন শেখ হাসিনা। তার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আর রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের বাইরে অন্য সব দল সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা কয়েক সপ্তাহের ছাত্র ও জনতার বিক্ষোভ, রক্তক্ষয় এবং দেশজুড়ে অশান্তির পর প্রধানমন্ত্রীর পদ এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

ছাত্র-জনতা-মেহনতি মানুষের অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। চলতি বছর এক বছর পূর্ণ হলো। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ প্রায় দেড় দশকের স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয় এই দিনে। এই দিনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিক এ পটপরিবর্তনের দগদগে স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ বাস্তবে কার্যত একটি ‘একনায়কতান্ত্রিক’ সরকারে পরিণত হয়েছিল। ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে বাস্তবিক অর্থে আর কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এ সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুটি হয়েছে অনেকটা একতরফা নির্বাচন। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনটি হয়েছে একেবারেই আমি-তুমি-ডামি নির্বাচন। জনগণের ভোটাধিকারের কফিনে শেষ পেরেক মারা হয়েছিল। ফ্যাসিবাদের গত ১৫ বছরে মানুষ আসলে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার বা মতামত জানানোর কোনো অধিকার পায়নি। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেটা করেছে, জোরজবরদস্তি করে একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করল। জনগণের কোনো রায় তারা নেয়নি। ফলে জনগণের সমর্থনও ছিল না তাদের পেছনে। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জবরদস্তি করে ভুয়া নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় ছিল।’

১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের আমলে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, বিরোধী গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিরুদ্ধমত দমন করা হয়েছে কঠোর হাতে। বিরোধী গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, দখল নেওয়া হয়েছে অথবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশে বহু বছর ধরে সামাজিকমাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিববিরোধী বক্তব্য পোস্ট করার জের ধরে মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ দমনের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকার ও পুলিশ বাহিনী মিলে পুরো দেশকে একটা ‘মাফিয়া স্টেট’ তৈরি করেছিল। আর এসবের জন্য সবসময়ই সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনী এমনকি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি এবং আওয়ামী লীগের দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলা ও গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমসহ বহু শিক্ষার্থী এবং নানা পেশার এক হাজারেরও বেশি মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে চোখের আলো নিভে গেছে ৪০০ জনের। মারাত্মক জখম ও আহত হয়েছেন ২৩ সহস্রাধিক মানুষ। পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে অনেককেই। এখনো শরীরে বুলেটের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন হাজারো মানুষ। এত ত্যাগের বিনিময়েই বিজয় এনে দিয়েছে আমাদের সন্তানরা।

ইতিহাসে লেখা হলো— ৫ আগস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনার পতন। সঙ্গে একটি নতুন বাংলাদেশের সূচনা। অনেকের জন্য এটা ছিল নতুন আশা, নতুন শুরু আর পুনর্গঠনের সুযোগ। তবে দিনটি একই সঙ্গে অন্য কিছুরও সূচনা করেছিল—বিশৃঙ্খলা। প্রতিটি সূচনার সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব একটি ঝড় আসে। অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার জয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও হাসিনা ও তার পরিবার পিছিয়ে থাকতে রাজি হয়নি। পুরো শেখ পরিবার দেশ ছাড়লেও বারবার হয়েছে সংবাদের শিরোনাম। দেশের বাইরে থেকেও তৈরি করেছে বিশৃঙ্খলার ঘূর্ণিঝড়। রহস্যময় ফোনকল, উদ্ভট অভিযোগ, রাজনৈতিক নাটকীয়তা এবং ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের মরিয়া চেষ্টা! কী ছিল না গত এক বছরে?

হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানও জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। আর সেখানে তিনি পৌঁছেছিলেন ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই। ইতিহাসে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন হলো, যেটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। মুজিবের জনপ্রিয়তা একবারেই শূন্যে চলে আসে। ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো পাঁচ দশক পর—২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। মোসাহেব ও মৌ-লোভীদের দ্বারা ঘেরা শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন দিন এভাবেই যাবে; কিন্তু মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কী ঘটিয়ে দিতে পারে, সেটা সম্ভবত ২৪ ঘণ্টা আগেও তিনি বুঝতে পারেননি।

শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে নিজের এতদিনের রাজনৈতিক অর্জন ধ্বংস করলেন। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের অস্তিত্বও হুমকিতে ফেলেছেন। ৫ আগস্ট এটাই প্রমাণ করেছে, যে কোনো স্বৈরাচারী শাসনই শেষ পর্যন্ত জনগণের ইচ্ছার কাছে পরাজিত হয়, হতে বাধ্য হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এ আন্দোলন রূপ নেয় একটি পূর্ণাঙ্গ গণঅভ্যুত্থানে, যা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়। যদিও আন্দোলনের পথ রক্তাক্ত ছিল, তবুও এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা নতুন করে জাগ্রত করেছে।

লেখক: রাজনীতিক কর্মী ও বিশ্লেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হজ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অনুমতি পেল ৩৩ বাণিজ্যিক ব্যাংক

আমরণ অনশনে অসুস্থ রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ শিক্ষার্থী

পিআরে নির্বাচন হলে ৫৪ বছরের কলঙ্ক মুক্ত হবে : ডা. তাহের

৯ দফা দাবি রাবি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের

‘এক বাড়ির এতগুলো কবর খোঁড়ার কাম আগে কোনোদিন করিনি’

কে কাকে দিয়ে ক্ষমতায় আসবেন সেই প্রতিযোগিতা ভুলে যান : রেজাউল করিম

‘জয় বাংলা’ গানে বিভ্রান্তি, আ.লীগ ভেবে ছাত্র-জনতার অনুষ্ঠানে হামলা

রাজধানীতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবে ইসলামী আন্দোলন, তারিখ ঘোষণা

চিকিৎসা পেশা নিয়ে মন্তব্যের জন্য ড. আসিফ নজরুলকে ক্ষমা চাইতে হবে : ড্যাব

রাকসু নির্বাচন / ভোটারের ৩৯ শতাংশই নারী, প্রার্থিতার আলোচনায় দুজন

১০

জন্মাষ্টমীতে কেশবপুরে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা

১১

জুলাই সনদের খসড়ায় যা আছে

১২

বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি, ডুবেছে ফসলি জমি

১৩

আটলান্টিকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘এরিন’, কখন কোথায় আঘাত হানবে 

১৪

বাঘায় খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় দোয়া মাহফিল

১৫

চাঁদার দাবিতে কারখানায় হামলা, আহত ৫

১৬

খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনায় বিএনপির দোয়া

১৭

কোচিংয়ে অস্ত্র-বিস্ফোরক, খায়রুজ্জামান লিটনের ভাইসহ আটক ৩

১৮

বিএনপির পক্ষে পাবনা-১ আসনে সাংবাদিক এম এ আজিজের প্রচারণা

১৯

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৮ অঙ্গীকারনামা

২০
X