মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে অন্যতম প্রতিবন্ধক শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি। বাংলাদেশের অগণিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ সমস্যা প্রকট। ক্লাসে যদি শিক্ষার্থী উপস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়, তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে যাওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের পাঠদান পরিবেশ সন্তোষজনক না হওয়া, একঘেয়ে পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষার্থীদের ক্লান্তি এবং কিন্ডারগার্টেন ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি। এ সমস্যাগুলো সমাধানে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। যদি পাঠদান প্রক্রিয়া আনন্দদায়ক করে তোলা যায়, তবে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এর গুরুত্ব বাঙালি মনীষীদের মধ্যে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের মতে, যে শিক্ষায় আনন্দ নেই; তা প্রকৃত শিক্ষা নয়। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ রেখে, খেলাধুলা, কল্পনা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে আনন্দপূর্ণ শিখন প্রক্রিয়ার ওপর জোর দিয়েছেন, সেখানে শুধু তথ্য অর্জন নয়, বরং সমগ্র মানবসত্তার বিকাশ ঘটে। তার শিক্ষা দর্শন ছিল সামগ্রিক ও জীবনমুখী, যা শিক্ষার্থীদের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে তাদের কল্পনা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে।
জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ গড়ে তোলা শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না অপরিপক্ব বয়সের কারণে। আনন্দের মধ্য দিয়ে তাদের এসব বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে তোলা যায়। আনন্দদায়ক শিক্ষা শুধু শিখন প্রক্রিয়াকে সহজ করে না, আকর্ষণীয়ও করে তোলে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান একঘেয়ে ও নিরানন্দ হলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিবিমুখ হয়। এমন উদাহরণ বহু বিদ্যালয়ে রয়েছে। তাই পাঠদানকে প্রাণবন্ত ও আনন্দমুখর করে তোলা অপরিহার্য।
পাঠদান যদি শিক্ষকদের মৌখিক বক্তৃতাসর্বস্ব হয়ে ওঠে তবে শিক্ষার্থী মনোযোগ হারায়। এ ক্ষেত্রে শিখন উপকরণ ব্যবহার তাদের মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। উপকরণ শিখন প্রক্রিয়াকে আকর্ষণীয়, আনন্দমুখর ও কার্যকর করে তোলে। গল্প বলা, সৃজনশীল প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন ও শিক্ষামূলক খেলা শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করলে পাঠদান আকর্ষণীয় হয়। ছবি, মডেল বা প্রাসঙ্গিক ভিডিও কনটেন্ট পাঠ্যপুস্তকের বিষয়কে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে সাহায্য করে। এসব উপকরণ শ্রেণিকক্ষে বৈচিত্র্য আনে, রঙিন ছবি ও ডিজিটাল কনটেন্ট শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে। হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা শিশুমনে স্থায়ী ছাপ ফেলে। ফলে তারা অধীত বিষয়বস্তু দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য শিক্ষকের দক্ষতা অপরিহার্য। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে পাঠ্যপুস্তকের ছবি, অডিও-ভিডিও উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থীরা সেটি জীবন্ত দেখতে পায়। স্মার্ট বোর্ডে শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও লিখতে ও ছবি আঁকতে পারে। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। আনন্দলাভের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি ব্যবহারেও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, যা তাদের পরবর্তী শিক্ষাজীবনে মূল্যবান ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এ প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলগত কাজ, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও ইতিবাচক প্রতিযোগিতা গড়ে তোলে।
পাঠদান প্রক্রিয়াকে আনন্দময় করে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অসামান্য। একটি প্রবাদ রয়েছে, উপদেশ অপেক্ষা দৃষ্টান্ত উত্তম। যে কোনো বিষয় ভালোভাবে মনে রাখার জন্য গল্প বা দৃষ্টান্ত ব্যবহার একটি কার্যকর উপায়। শিক্ষক কঠিন বা জটিল বিষয়গুলোকে দৃষ্টান্তের মাধ্যমে উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থীরা সেটি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে। শেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে উদ্দীপনা ও প্রশংসা একটি আনন্দদায়ক উপায়। প্রশংসা তাদের আত্মবিশ্বাসী করে। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাফল্যকে স্বীকৃতি দেন ও প্রশংসা করেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা উদ্যমী হয়ে ওঠে এবং শ্রেণিকক্ষে আরও মনোযোগী হয়।
উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে আনন্দদায়ক খেলা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে। জাপান, ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় খেলাধুলা, নাটক, সংগীত, ছবি আঁকা, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে পরিচয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাদের শিক্ষাদর্শন বলে, শিশুদের মনোজগতে আনন্দ না থাকলে শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া কার্যকর হয় না। শেখার সময় যদি শিশু আনন্দ পায়, তাহলে পড়াশোনার প্রতি তার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা তৈরি হয়।
আনন্দবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা বইকে বোঝা বানিয়ে দেয়। বইয়ের বোঝা হ্রাস করার পরামর্শ শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই দেন। শিক্ষার্থীরা যদি পড়ার আনন্দ একবার পায়, তাহলে আর বইকে বোঝা মনে করবে না। হাসিমুখে যদি তারা শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে পাঠদান প্রক্রিয়া অর্থবহ হবে। বই বা শিক্ষকের প্রতি যদি শিশুদের অনীহা বা ভীতি তৈরি হয়, এর প্রভাব তাদের অবশিষ্ট শিক্ষাজীবনে রয়ে যাবে। কখনো কখনো শিক্ষকের গুরুগম্ভীর ও রাগান্বিত আচরণ শিশুমনে এমন গভীর প্রভাব ফেলে, যা অনেকেই পরবর্তী সময়ে কাটিয়ে উঠতে পারে না। আনন্দদায়ক পাঠদান এ নেতিবাচক দিকগুলোকে নির্মূল করতে পারে।
১৭৮৯ সালে ইংরেজ কবি উইলিয়ম ব্লেক ‘দ্য স্কুল বয়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। স্কুলপড়ুয়া এক বালক স্কুলের দমবন্ধ পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠেছে। শিক্ষকদের কঠোর এবং আনন্দহীন শিক্ষাদানে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বরং সে স্কুলের বাইরে গ্রীষ্মকালীন সকালে প্রতিটি গাছে পাখির গান উপভোগ করতে চেয়েছে। সে তার বাবা-মাকে স্কুলের ওই বন্দিদশা থেকে তাকে উদ্ধার করতে মিনতি জানিয়েছে। এ অসহায় বালকটি যেন আমাদের শিশুদের প্রতীকী রূপ। শিক্ষা লাভ করা প্রত্যেক শিশুর মৌলিক অধিকার এবং এই শিক্ষা অবশ্যই আনন্দের ভেতর দিয়ে হতে হবে। শিক্ষার্থীর মনে স্বপ্ন জাগিয়ে দিতে হবে যে, স্বপ্ন সে ঘুমিয়ে দেখবে না। বাস্তবে সেই স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাবে।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করতে প্রাথমিক বিদ্যালয় সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান শিশুর মধ্যে বিদ্যালয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে। এভাবে সহপাঠীদের মধ্যে সম্প্রীতি ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। শিক্ষার্থী তখন বিদ্যালয়কে নিজের পরিবারের মতো অন্তরঙ্গ ও আপন ভাবতে শেখে। শ্রেণিকক্ষ তার কাছে আদরণীয় ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ফলে বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হতে ও পাঠ গ্রহণ করতে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হয়। এর প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনন্দদায়ক পাঠদানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলে মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়ন সহজ হবে।
লেখক: জেলা প্রশাসক, লক্ষ্মীপুর
মন্তব্য করুন