

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের অনিবার্য প্রয়োজনে বিএনপি গঠন করেছিলেন। তার সততা ও কর্মদক্ষতায় দলটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। মহাপরাক্রমশীল আওয়ামী লীগ-জামায়াত-বামসহ অসংখ্য ছোট-বড় দল বাকশালী রাজত্বে নিষিদ্ধ ছিল। জিয়ার দেওয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুযোগে দলগুলো পুনর্জীবন লাভ করে। তবে, দেশজুড়ে সংগঠন থাকার পরও সে সময় নৌকার পালে হাওয়া লাগাতে পারেনি আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবে যায় তারা। অনেক ডাকসাইটে নেতা থাকার পরও বাম দলগুলো গণমানুষের কাছে পৌঁছতে পারেনি। ধর্মাশ্রয়ী জামায়াতও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি উদার সংস্কৃতির বাংলাদেশে। অন্যদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও স্বনির্ভর তত্ত্ব লুফে নেয় দেশের সাধারণ জনগণ। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অদম্য সাহসী কূটনীতির জন্য আপামর জনতার বিশ্বাস অর্জন করেন তিনি। আওয়ামী লীগসহ সমমনারা ক্যান্টনমেন্টের দল বলে বিএনপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করেছে অনেক। কিন্তু ক্ষমতায় থেকে গড়া হলেও দলকে পরম মমতায় জনগণের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়া। তার দেশপ্রেম ও ব্যক্তিত্বে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ক্ষণজন্মা জিয়ার দলকে। এজন্য মহান দুই নেতা-নেত্রীর পারিষদবর্গেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। দেশের সেরা রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবী নেতৃত্বকে পাশে টেনেছেন। তারাও দুহাত ভরে দেশসেবার সুযোগ নিয়েছেন। একই তরিকায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও হাতে-কলমে রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে পারিষদবর্গ নিয়ে। গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য হাওয়া ভবন পরিচালনা করলেও অদক্ষ এবং মেধাহীন পাত্র-পাত্রীর জন্য বদনাম হয়েছে তার। প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে সুবিধাভোগী অনুসারীরা। তারাই দলের সম্মান নষ্ট করেছে। অর্বাচীন, অপরিণামদর্শীদের পরামর্শে অনেক ভুগতে হয়েছে রাজনীতির বরপুত্র তারেক রহমানকে।
রাজনীতিতে কট্টর আওয়ামী লীগ ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে বিএনপি ও তার নেতৃত্বকে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোকে বিএনপি ধ্বংসে ব্যবহার করেছেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা। সরকারবিরোধী আন্দোলন দমাতে নানা ছলাকলা ও ষড়যন্ত্র ছিল রুটিন ওয়ার্ক। ভয় ও লোভ দেখিয়ে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকে তথ্য দিতে বাধ্য করা হতো বলে জনশ্রুতি আছে। ঘনিষ্ঠ মহলে শেখ হাসিনা গর্ব করে বলতেন, সব দলকেই তার দেখতে হয়। এজন্য মাসোহারা হিসেবে অনেক খরচ হয়। সে সময় বিএনপির গোপন বৈঠকের খবরও গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছে যেত। অনেক কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের আগে স্পটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিতেন। ভাড়াটে লোক দিয়ে নিরীহ কর্মসূচিকে সহিংস করে তুলতেন তারা। এর দায়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের আটক করা হতো। নির্যাতিতরা প্রায়ই দলের সন্দেহভাজন বেইমান নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন। আন্দোলনের সতেরো বছরে বিএনপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে পাঁচ শতাধিক মামলা হয়েছে। অন্যদিকে কারও কারও শরীরে ফুলের টোকাও লাগেনি। ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। আবার, মান রক্ষায় তদবির করে ঘাড়ে মামলা নিলেও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ কেউ। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও পলাতক আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সংসদ সদস্য শাজাহান খানসহ অনেকের সঙ্গে সখ্য ছিল তাদের। চাঁদাবাজির পার্টনার হিসেবে বিএনপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। পদ হারানোর ভয়ে সাক্ষীরা নীরব থেকেছেন। সরব হওয়ার সাহস পাননি দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে তাদের তথাকথিত সরাসরি সংযোগ থাকার ভয়ে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ফাঁকা মাঠে একক চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েন তারা। পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পদ ও সম্মান রক্ষায় নিজে থেকে দায়িত্ব নেন কেউ কেউ। তাদের উত্থানে দলের সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের হতাশা বাড়ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মেয়ে সামারুহ মির্জা গত বৃহস্পতিবার ফেসবুকে এ বিষয়ে একটি পোস্ট দেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘পনেরো বছরে গায়ে অনেকের আঁচড় লাগেনি। এখন উড়ে এসে জুড়ে বসে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।’ প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এসব ঘটনা পুঁজি করে বিএনপির গায়ে চাঁদাবাজ-দখলবাজ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। জামায়াতের নেতৃত্বে সমমনা দলগুলো নতুন নতুন বয়ান দিচ্ছে বিএনপির বিরুদ্ধে। কখনো ভারতপ্রেমী, কখনো আওয়ামী লীগ-জাপার রক্ষাকর্তা কখনোবা নব্য ফ্যাসিস্ট বলা হচ্ছে। এককভাবে ক্ষমতায় গেলে কী করবে তারা! এরকম ভয়ভীতি ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। বরাবরের মতোই পাল্টা জবাব দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপি। বরং সমালোচনা শুনলে শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভুল বুঝছে। মুক্ত হাওয়ায় ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বিএনপির আকাশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল ঝকঝকে মনে করছেন তারা। অথচ, রোদেও বৃষ্টি হয়। সে বৃষ্টিতে শুধু শিয়ালের বিয়ে হয় না, সবকিছু ভিজে যায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলেছেন, এবারের নির্বাচন কঠিন হবে। তারপরও কিছু নেতাকর্মী সতর্ক হচ্ছেন না। তাদের কারণে দলের সাত হাজার সদস্য শাস্তি প্রাপ্তির বিষয়টা দিন দিন হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে।
শহীদ জিয়া নানা মত-পথের মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন তার দলে। বিভিন্ন আদর্শের মেধাবীদের এক ছাতার নিচে এনেছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই—আধুনিক, উন্নত দেশ গড়তে হবে। স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। রাজনীতি হতে হবে উৎপাদনমুখী। জনগণকে স্বনির্ভর করতে হবে। লক্ষ্য পূরণে পদে পদে কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে তাকে। তারপরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দলের ভেতরে উপদল, কোন্দল। সততার শক্তিতে বলীয়ান জিয়া কঠিন হাতে তা দমন করেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এসব ব্যাপারে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তাকে। প্রথম দিন থেকেই খালেদা জিয়াকে লড়তে হয়েছে ঝানু রাজনীতিবিদদের মধ্যে নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায়। শরিক দল হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে হারিয়েছেন প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক নেতাকে। আপসহীন ব্যক্তিত্ব দিয়ে আগলে রেখেছেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে। কিন্তু তারেক রহমানের সামনে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ। আদর্শের পাশাপাশি যোগ হয়েছে সীমাহীন লোভী গোষ্ঠী। ভুঁইফোঁড় মেধাবী, কৃত্রিম ত্যাগী, অভিনয়ে পটু নেতা, শিল্পী কোটায় মৌসুমি মনোনয়ন প্রার্থীতে সয়লাব এখন বিএনপি। উপদেষ্টার ছড়াছড়ি। তাদের অর্জিত প্রচারিত ডিগ্রি ভুয়া বলে সরগরম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। হতে পারে ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বীরা। কিন্তু প্রতিবাদে নেই উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের চ্যালেঞ্জ।
যতই দিন যাচ্ছে বিএনপির ভোট কমছে, জামায়াতের বাড়ছে। এ প্রচারণা চলছে দেদার। বিপরীতে মাঠে নেই বিএনপির কোনো নিজস্ব ইনফ্লুয়েন্সার। ভাড়া করা ইনফ্লুয়েন্সাররা কিছুদিন আগেও ছিল হাসিনার হারমোনিয়াম। তাদের মঞ্চে তুলে নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে দলটিতে। বিএনপি কোনো সময়ই ক্যাডার বা কর্মীনির্ভর দল নয়। সবসময় সাধারণ সমর্থক এবং ভাসমান ভোটারের ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। এটা বারবার প্রমাণিত। আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীরা অনলাইনে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফেরা প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছেন। অথচ, অশ্লীল ইউটিউবারের ইমামতিতে অনলাইনে জামায়াতসহ উগ্র ইসলামী গ্রুপগুলো বিএনপিকে আক্রমণ করছে। অদ্ভুত কাণ্ড! বিএনপির অনেক সাধারণ সমর্থকও ভিও ব্যবসায়ী ইউটিউবারদের বয়ান বিশ্বাস করেন। তাদের মধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবীও রয়েছেন। সঠিক নার্সিংয়ের অভাবে তাদের সমর্থন দিন দিন জামায়াতের দিকে যাচ্ছে। পরিচ্ছন্ন, ত্যাগী রাজনীতিবিদ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রেহাই পাচ্ছেন না তাদের ট্রল থেকে। আওয়ামী লীগের মতো একই কাজ করতে চান না বলে, তাকে ভারতপ্রেমী বলে উপহাস করা হচ্ছে। সরল উচ্ছ্বাসে ড. ইউনূসের প্রশংসা করায় তাকে নিয়ে ট্রল শুরু করে আওয়ামী অ্যাকটিভিস্টরা। বুঝে না বুঝে অভ্যুত্থানকারী দল এবং তাদের সমর্থকরাও মির্জা ফখরুলের সমালোচনা করছেন। বয়স, অসুস্থতা ও হতাশার চাপে তিনিও হয়তো কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলছেন। না হলে কেন এ সময় ভারতের একটি রাজ্যের তৃতীয়সারির পত্রিকার সঙ্গে কথা বলতে হবে তার! বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের খরচে ভারতীয় নির্মাতার ‘জুলাই ডকুমেন্টারি’ অন্য টিভিতে প্রচারে সহযোগিতা করেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহাসচিবের কাছে এসব সুযোগসন্ধানীকে নিয়ে যায় কে? কার কী উদ্দেশ্য-বিধেয়, তা নিরূপণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
গত সতেরো বছর যুগপৎ আন্দোলনের সময় অনেকেই বিএনপির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। বাম-ডান মিলে বিএনপির পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছে। তাদের মধ্যে পেশাজীবী নেতৃত্বই বেশি। তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায় কে গুপ্ত জামায়াত, সাবেক জাসদ ছাত্রলীগ বা খাঁটি বাম। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত যার যার আদর্শ বাস্তবায়নে হরদম খেলা চলছে। সময় এসেছে দলকে জামায়াতি-বামাতি মুক্ত করার। শহীদ জিয়ার আদর্শ ছাড়া বিএনপি বাঁচবে না। এখনই শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। না হলে বাম-ডান করতে করতে আরামে দাঁড়ানো হবে না বিএনপির। অশিক্ষিত, দিনমজুর, শ্রমিক, নিম্নবিত্ত মানুষ দলটিকে ভালোবেসে ‘বিম্পি’ ডাকে। ভুল নামে ডাকলেও তারা ক্ষতি করে না দলের। কিন্তু শুদ্ধ উচ্চারণে অনেকে বিএনপিতে বাণিজ্য করে। তারা নিজে লাভবান হয় দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারাই আসলে বিম্পি। আওয়ামী লীগকে জয় বাংলা করে দিয়েছে যারা, বিএনপিকেও বিম্পি করে দেবে তারা।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি
মন্তব্য করুন