[চতুর্থ পর্ব]
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক Robert E. Klilaard তার এক লেখায় গান্ধীর সত্যাগ্রহ ও অহিংস পন্থাকে একটি নিছক ‘কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, Satyagraha is often seen as the hope of the future, a long awaited means of Peaceful conflict resolution. [অর্থাৎ সাধারণত সত্যাগ্রহকে দেখা হয় ভবিষ্যতের আশাবাদ বা প্রত্যাশা হিসেবে, দ্বন্দ্ব বা বিবাদ নিরসনে (Conflict resolution) এটা এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার শান্তিপূর্ণ পথ]। (Gandhi’s Non-Violence as a tactic; sage Journal-1971)
এ ক্ষেত্রে বিপ্লবী সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গণঅভ্যুত্থান বা পথের কথা বলেছেন Frantz Fanon তার The wretched of the Earth বইয়ে। তিনি বলেন, ‘বি-উপনিবেশীকরণ বা উপনিবেশক থেকে মুক্তি আসলে একটি বিশৃঙ্খলা বা শান্তিভঙ্গের পথ। এটা তারই এজেন্ডা। তবে এটাও সত্য যে, কোনো জাদুর কাঠি বা অলৌকিক লাঠি দিয়ে সম্ভব নয়। প্রলয়কাণ্ড না ঘটিয়ে অথবা ভদ্র মানুষের মতো উপনিবেশিকতা এবং এর উত্তর-উপনিবেশের ব্যাধি দূর করা যাবে না। কারণ বিনা নোটিশে শান্তশিষ্টভাবে এটা সম্ভব নয়। বি-উপনিবেশীকরণ হচ্ছে ইতিহাসের ধারা, যা ‘ভায়োলেন্স’ ছাড়া নির্মূল করা যায় না। (‘on violence’ chapter; Grove Press- New York- Page-2-6)
আমরা আলোচনা করছি কেন বাংলাদেশে বিপ্লবকে হত্যা করা হয়, ব্যর্থ করার জন্য এর সম্ভাবনাকে। আমরা এ ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সাল নিয়ে আলোচনা করছি। শেষ পর্যন্ত ভারত ভাগ হলো হাজার হাজার সাধারণ মানুষের জীবন দিয়ে। দেশত্যাগের দগদগে আঘাত, বেদনা আর হতাশার মধ্য দিয়ে। আমরা কতটা স্বাধীনতা পেয়েছি তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, অন্তত মনে এই প্রশ্ন জাগে, স্বাধীনতা না দেশভাগ? স্বাধীন মানুষ না লাখে লাখে উদ্বাস্তু? হয়তো সশস্ত্র বিপ্লবী পন্থায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে বিদায় করলে এসব ঘটনাবলি ঘটত না! হয়তো ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়—লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’ স্লোগানটিও শুনতে হতো না? কাজেই বিপ্লবী পথকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৪৭ সালেই—দেশভাগের মধ্য দিয়ে।
তবে উল্লেখযোগ্য এবং আশ্চর্যজনক অধ্যায় যে ইতিহাস লুকিয়ে রাখা হয়েছে তা হলো, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহি সংগ্রাম, ১৯৪৬ সালের নৌ-সেনাদের সশস্ত্র সংগ্রাম, ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৬ সালের কলকাতাসহ বাংলাজুড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ ছাড়া পাঞ্জাবসহ ভারতের অন্যান্য অংশে দাঙ্গা-ব্রিটিশদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল-এর পরও অনড় এবং অবিচল থাকলেন ভারতকে হাতছাড়া না করতে। কিন্তু তিনি ভারত থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের যে সীমাহীন অর্থ ব্যয় হলো এবং এর ফলে ইংল্যান্ডে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় হলো সে কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের ব্যয় হয়েছিল তৎকালীন সময়ে সাড়ে ৩০০ কোটি পাউন্ড। এর মধ্যে শুধু ব্রিটিশ ভারতকেই দিতে হয়েছে ১৬০ কোটি পাউন্ডের বেশি। এ চাপই মূলত ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের অন্যতম কারণ। আর তাড়াহুড়া করে ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক ভারতকে বিভাজনে এত আগ্রহী করে তোলে। আর এ কারণেই উত্তর-উপনিবেশিকতার মনস্তাত্ত্বিক শৃঙ্খল থেকে ভারতের বিভক্ত দেশ দুটি আর রক্ষা পায়নি।
তা ছাড়া দেশভাগের ব্যাপারে ভারতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের তাড়াহুড়াটা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। তারা চাইছিলেন, যেনতেন প্রকারে হলেও ভাগটা সম্পন্ন হোক। তারা ব্রিটিশদের স্বেচ্ছায় ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্তের বিষয়টি মাথায়ই নিলেন না। আর এই অসম্ভব তাড়াহুড়াই পরবর্তীকালে নানামুখী যেমন সীমানা নির্ধারণ, ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্বসহ অন্যান্য বিষয় রয়েই গেল। বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের যারা বিরোধিতা করেছিলেন, সে তারাই ১৯৪৭-এর দেশভাগের শিকার হলেন। বাংলা থেকে আসাম, ত্রিপুরা তো গেলই, বাংলাও বিভক্ত হলো। মূলত বাংলার কৃষক সমাজ যারা পাকিস্তান আন্দোলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন—তারা প্রতারিত হলেন।
এর ওপরে অধ্যাপক তাজুল ইসলাম হাশমী তার বই Pakistan as a peasant Utopia (অর্থাৎ পাকিস্তান হচ্ছে কৃষকদের অলীক স্বপ্নরাজ্য বা কাল্পনিক রাষ্ট্র।) [বিস্তারিত আলোচনার জন্য বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রকাশ করে Routledge Publishing-London, New York-1992]
শুধু যে বাংলায় দেশভাগের সমস্যাটি হয়েছে, তা নয়। ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব নিয়ে সংকটটি আরও তীব্র ও ব্যাপক। পাঞ্জাবে ১৯৪৭ সালে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। সমস্যা রয়ে গেছে কাশ্মীর নিয়ে। এসব হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ব্রিটিশ রাজতান্ত্রিক সরকারের কূটকৌশলের কারণে।
তাড়াহুড়াটা এমন ছিল যে, তৎকালীন ব্রিটিশ সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক লিওনার্দ সোজলে তার বই ‘দ্য লাস্ট ডে’জ অব দ্য ব্রিটিশ রাজ’, যা ১৯৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়, পরে বলছেন, “ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে ব্রিটেনের সদিচ্ছা থাকলেও কোনো প্রস্তুতি ছিল না। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব এবং একের পর এক মারাত্মক ভুলভ্রান্তি বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। জিন্নাহর পাকিস্তান পরিকল্পনা মেনে নেওয়া হলেও এর পরিণাম সম্পর্কে ভেবে দেখা হয়নি। অবিভক্ত সেনাবাহিনী বিভক্তির ব্যাপারেও পূর্বাহ্ণে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। তখনো দেশভাগের মাত্র ৬ সপ্তাহ বাকি। ১৯৪৭-এর মে মাসে দেশবিভাগ সম্পর্কিত ঘোষণাটি প্রচার করা হলেও জুন মাসের শেষ দিক পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ কমিশন নিয়োগ করা হয়নি। ১৫ আগস্ট দেশ ‘স্বাধীন’ হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দুদিন পরেও আমজনতা জানত না—কে কোন দেশের নাগরিক।” মোজলে আরও বলেন, ‘একটু ধৈর্য ধারণ করলেই হয়তো সংকট এড়ানো যেত। পাকিস্তান সৃষ্টি শুধু একটা মানুষের কাজ—ইনি হলেন জিন্নাহ। ...নেহরু, প্যাটেল এবং অন্যান্য ক্ষমতাপাগল কংগ্রেস নেতাদের মাউন্টব্যাটন ক্ষমতার লোভ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই লোভ তারা সম্বরণ করতে পারেননি।’ [লিওনার্দ মোজলের বইয়ের বাংলা অনুবাদ—ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিনগুলো; বাংলা একাডেমি; ১৯৮৮, পৃ-৩০২-৩০৫]
লিওনার্দ মোজলে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জওহরলাল নেহরুর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তাতে নেহরু বলেন, ‘আসল কথা এই যে, আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং আমাদের বয়সও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই আবার কারাবাসের কথা চিন্তা করতে পারতেন।... কিন্তু গান্ধী যদি দেশভাগ প্রস্তাব মেনে নিতে বারণ করতেন, তাহলে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যেতাম। কিন্তু তিনি তা করেননি।’
আরও পড়ুন : বিপ্লব কেন বারবার ব্যর্থ হয়
বিপ্লব কেন বারবার ব্যর্থ হয় [দ্বিতীয় পর্ব]
বিপ্লব কেন বারবার ব্যর্থ হয় [তৃতীয় পর্ব]
বাংলাদেশে বিপ্লব বা বিপ্লবের প্রথম ধাপই কেন বারবার ব্যর্থ হয় বা তাকে হত্যা করা হয়—সে প্রশ্নে আমাদের অতীত নিয়ে আলোচনাটি জরুরি। তাড়াহুড়া করে প্রস্তুতিবিহীন অবস্থায় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ ক্ষমতা নিলেও তাদের কোনো ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ছিল না। এ সম্পর্কে স্বনামধন্য অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশি নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তিকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পরে কী হবে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো কর্মসূচি ছিল না। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো কোন ধরনের ইতিবাচক কর্মসূচি গ্রহণের বদলে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ অবসানের ঘোষিত লক্ষ্যেই নিজেদের নিবদ্ধ রেখেছিল।’ [Abdur Razzak; Political Parties in India; UPL, Feb, 2022, Page-8]
ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এ সম্পর্কে আগেই আয়েশা জালালের লেখা থেকে উদ্ধৃতিসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অবিভক্ত পাকিস্তান যে গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতেই পারেনি এবং এতে পূর্ব পাকিস্তান এবং এর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে ওই রাষ্ট্রটির ওপরে সন্তুষ্ট নয়—তা প্রমাণিত হয়েছে বারবার। (চলবে)
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মন্তব্য করুন