

পটুয়াখালীর দুমকিতে জুলাই আন্দোলনে শহীদ বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া হতভাগ্য শিক্ষার্থীর কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার স্মৃতি আমাদের মন থেকে এখনো মুছে যায়নি। আমাদের সামাজিক জীবনে একের পর এক এত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যে, এসব ঘটনার ঘনঘটায় মানুষ সহজেই অনেক মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনাও সহজেই ভুলে যায়। যাই হোক, পটুয়াখালীর সেই ধর্ষণের মামলায় তিন কিশোরকে পৃথক আইনে সাজা দিয়েছেন আদালত। তাদের মধ্যে দুই কিশোরকে ১৩ বছর করে, অন্যজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত বুধবার পটুয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ রায় দেন। আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সাধারণ মানুষ ও মানবাধিকারকর্মীরা সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আদালত রায়ে উল্লেখ করেছেন, আসামিরা প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত শিশু সংশোধনাগারে থাকবে। এরপর প্রচলিত আইনে তারা অন্য আসামিদের মতো কারাগারে সাজা ভোগ করবে।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা আন্দোলনের সময় চব্বিশের ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ১০ দিন পর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তাকে দুমকি উপজেলার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। চলতি বছর ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় বাবার কবর জিয়ারত করে নানাবাড়িতে ফেরার পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ওই কলেজ শিক্ষার্থী। ধর্ষণের সময় এজাহারভুক্ত আসামিরা তার নগ্ন ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিল। এরপর ভুক্তভোগী তার মা ও পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে ২০ মার্চ দুপুরে থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে অভিযুক্ত তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ২৬ এপ্রিল রাতে রাজধানীর শেখেরটেক এলাকার ভাড়া বাসা থেকে ওই ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ২৭ এপ্রিল বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
বাংলাদেশে ধর্ষণ এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায়ই নারী, শিশু ও কিশোরীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। প্রতিদিনের সংবাদে নতুন নতুন ধর্ষণের ঘটনা আমাদের বিবেক নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এ অপরাধের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে আর কেন অপরাধীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠছে?
মূল কারণগুলোর একটি হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অধিকাংশ ধর্ষণ মামলায় ন্যায়বিচার পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়, অনেক সময় মামলার সাক্ষী ও প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো সামাজিক লজ্জা ও হুমকির মুখে পড়ে মামলা তুলেও নেয়। ফলে অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং এ দৃষ্টান্তহীনতা আরও অপরাধকে উসকে দেয়। দ্বিতীয়ত, নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পরিবর্তিত হয়নি। অনেক সময় ধর্ষণ ঘটনার পরও সমাজে নারীই দায়ী হয়ে পড়ে—তার পোশাক, চলাফেরা, কিংবা সময় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অথচ অপরাধীর চরিত্র, মানসিকতা ও সামাজিক পটভূমি নিয়ে তেমন বিশ্লেষণ হয় না। এ মানসিকতা আমাদের সমাজকে আরও অসুস্থ করে তুলছে।
আমরা মনে করি, ধর্ষণ শুধু একজন নারীর প্রতি অপরাধ নয়। ফলে ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করাটাই শেষ কথা নয়। সমাজে যাতে এমন হীনতর ঘটনা না ঘটে, এজন্য গণসচেতনতা জরুরি।
মন্তব্য করুন