

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেল চলাচলের ট্র্যাকের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। কালবেলা পরিবারের পক্ষ থেকে নিহতের আত্মার শান্তি কামনা করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা। পাশাপাশি এক বছরে দ্বিতীয়বারের মতো মেট্রোরেল চলাচলের ট্র্যাকের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় স্বভাবতই নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—মেট্রোরেলের নিরাপত্তা মান ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে।
রোববার রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। দুপুর ১২টার দিকে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে খুলে পড়ে একটি বিয়ারিং প্যাড, যার আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারা যান পথচারী আবুল কালাম। তিনি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামের জলিল চোকদারের ছেলে। কৈশোরেই বাবা-মা হারান। বেড়ে ওঠেন বড় ভাইবোনদের কাছে। স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায়। কাজ করতেন রাজধানীর মতিঝিলের এক ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে। নিয়তির খেলায় পিতার চেয়ে আগেই শিশু অবস্থায় সন্তানদের বরণ করতে হলো পিতা হারানোর অশেষ বেদনা। আর স্বামী হারিয়ে যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের শিকার হন স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া। স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে তিনি যে আহাজারি ও আর্তনাদ করেন, তা যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের হৃদয়েই রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এইটা মৃত্যু না, হত্যা। এইটা মেট্রো কর্তৃপক্ষের অবহেলা। বাচ্চা দুটি তাদের বাবাকে হারাল। সেটার ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে? আমার চাঁদগুলোর কী হবে? আব্দুল্লাহ ও সুরাইয়া আর বাবার সঙ্গে খেলতে পারবে না। আমার চাঁদগুলো কাকে বাবা বলে ডাকবে?’—প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর পাথরকঠিন।
এ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কর্তৃপক্ষের রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতি, অবহেলা, মেট্রোরেল নির্মাণত্রুটিসহ একাধিক প্রশ্ন সামনে এসেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে, তখনো বিশেষজ্ঞরা এমন প্রশ্ন তোলেন এবং দেন পরামর্শ। তখন একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু দেখা যায়নি কোনো পদক্ষেপ। তদন্ত কমিটিইবা কী রিপোর্ট করেছিল, তা দেখেনি আলোর মুখ। এবারের ঘটনায়ও তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কেউ জানি না, এ কমিটির কার্যকারিতা কতটা কী হবে। গতবারের ঘটনা পরবর্তী অভিজ্ঞতায় সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক কিছু হবে না। এবারের ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অল্প সময়ের মধ্যে দুবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে মেট্রোরেলের পুরো ট্র্যাকের নিরাপত্তা নিরীক্ষার তাগিদ দেন তারা।
প্রশ্ন উঠছে, মেট্রোরেলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় এবং ব্যয়ের ব্যাখ্যা হিসেবে এটি নির্মাণে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান জাইকার ‘উচ্চগুণগত মান’ রক্ষার বক্তব্য নিয়েও। তারা বলেছিল, উচ্চগুণগত মানের কারণে মেট্রোর প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় বেশি হলেও রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত ব্যয় কম হবে। যদি তাই হয়, তাহলে এত কম সময়ে বারবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ছে কেন?
আমরা মনে করি, মাত্র এক বছরে এমন উচ্চব্যয়সম্পন্ন মেট্রোরেলের দুবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্যও গভীর উদ্বেগের। আগামীতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। যাতে করে আবুল কালাম ও তার পরিবারের মতো এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার আর কারও না হতে হয়; কোনো নাবালক শিশুকে পিতৃহীন হতে না হয়, অকূলপাথারে ভাসতে না হয় স্বামীর অনুপস্থিতিতে শিশুসন্তান নিয়ে কোনো গৃহবধূকে।
মন্তব্য করুন