

বইয়ের পাতায় স্বপ্ন জাগে, আলো ছড়ায় পথে, যে বই পড়ে, সে হারায় না জীবনের কোনো রথে। বই হলো মনের জানালা। মনের দিগন্ত বিস্তৃত হয় বই পড়ার মাধ্যমে। যে যত বই পড়বে, তার মনের বিশালতা তত বাড়বে, নিজেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারবে। প্রযুক্তির আধিপত্য ও সহজলভ্যতা আমাদের একটি অন্তঃসারশূন্য শিক্ষিত সমাজ উপহার দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটা বিশাল সংকট তৈরি করবে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এ প্রজন্ম বই পড়া থেকে যোজন যোজন দূরে চলে যাচ্ছে। যেখানে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হলে একাডেমিক বই পড়ার পাশাপাশি গল্প, কবিতা, উপন্যাস বা সাহিত্যের শাখায় শাখায় বিচরণ থাকা উচিত প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর; সেখানে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাব, চ্যাটজিপিটির মতো আধুনিক প্রযুক্তিগুলো আমাদের কাছে সহজলভ্য হওয়ায় আমাদের সেই বই পড়ার সময় এখন নেই। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা এ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার যুগের আগে অনেক বেশি পরিমাণে দেখা যেত। বই পড়া ছিল তখন শিক্ষার্থীদের প্রধান শখ। এ অনুরাগ কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রযুক্তির প্রভাব।
আজ সোশ্যাল মিডিয়া, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটকের এ দুনিয়ায় তাদের কাছে যেন দুই পাতা বই পড়ার সময় নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা যায়, স্ক্রল করা যায়, বই পড়ার সুযোগ হয় না। শর্ট ভিডিও, রিলস দেখার কারণে শিক্ষার্থীদের ধৈর্যশক্তি কমে যাচ্ছে, যার ফলে তারা বইয়ের পাতায় তার মনোযোগটা ধরে রাখতে পারে না। সারাক্ষণ অস্থিরতা কাজ করে মনের মধ্যে। একটা শিক্ষার্থীর মোবাইলের স্ক্রিন টাইম যদি সাত-আট ঘণ্টা হয়, তবে একজন আদর্শ শিক্ষার্থী আমরা কখনো খুঁজে পাব না।
আধুনিক জীবনযাত্রার প্রভাবও একইভাবে দায়ী করছে এখানে। আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে চলতে গিয়ে তারা বই পড়ার উপকারিতা উপলব্ধি করতে ভুলে গেছে। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বই পড়ার অভ্যাস থেকে দূরে সরে গেছে শিক্ষার্থীরা। বই না পড়ার আরও কিছু কারণের মধ্যে একাডেমিক ক্ষেত্রে পড়াশোনার অতিরিক্ত প্রেশার, কোচিংও দায়ী। এসব করে শিক্ষার্থীদের ধৈর্য থাকে না কবিতা, উপন্যাস বা সাহিত্য পড়ার। একাডেমিক প্রেশারই যেন তাদের পিষে শেষ করে দিচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে গুগল, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব থেকে দ্রুত তথ্য পাওয়া। বইয়ের গভীরতা ও বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পেতে দরকার ধৈর্য, যা এই তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগই হারিয়ে ফেলেছে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃত জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করাতে হলে তাদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও প্রতিষ্ঠানিক বিভিন্ন বিষয়ের বই-সমৃদ্ধ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে সবার জন্য উন্মুক্ত করা, পাঠচক্র ও প্রতিযোগিতার আয়োজনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কোচিং গাইড থেকে দূরে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও পরিবারের অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারের সীমিতকরণ করতে হবে। প্রযুক্তির ক্ষতি তুলে ধরে সেমিনার, বিতর্ক ও টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে প্রচার করতে হবে নিয়মিত। তাহলে আমরা একটি সৃজনশীল ও জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রজন্ম উপহার দিতে পারব দেশকে, যারা বিশ্ব সভ্যতায় অবদান রেখে দেশ করবে গর্বিত।
বই মানুষের আত্মচেতনাকে জাগ্রত করে, চিন্তার গভীরতা বাড়ায় এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা শানিত করে। এ অভ্যাস মননকে বৃহৎ ও পরিণত করে তোলে। আজকের সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক যুগে মস্তিষ্ককে সস্তা ও অপ্রয়োজনীয় কনটেন্টে ভরিয়ে ফেলার পরিবর্তে প্রতিটি শিক্ষার্থীর উচিত বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং জ্ঞানসমৃদ্ধ পাঠে মনোনিবেশ করা। পরিবর্তন হোক আমার পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে শপথ হোক—বইয়ের সঙ্গে ভালোবাসার ও জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রজন্ম গড়ার।
তানিয়া আক্তার, গণিত বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন