

আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। মহান বিজয় দিবস দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দময় মুহূর্ত। একাত্তরের এই দিনে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামে স্বাধীন-সার্বভৌম নতুন একটি দেশের। এবার আমাদের জাতীয় জীবনে বিজয় দিবস এসেছে এক তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। সামনেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তব করেছিল, সেই বিজয়ের মূল চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এখন জাতি আবার একটি জাতীয় নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, ফলে এবারের বিজয় দিবস আমাদের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বিজয় দিবস শুধু একটি ঐতিহাসিক স্মৃতির দিন নয়; এটি আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধে মানুষ জীবন দিয়েছিল যেন তারা নিজের শাসক নিজে বেছে নিতে পারে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পায়, রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহি আদায় করতে পারে। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সেই আকাঙ্ক্ষাগুলোরই সমসাময়িক পরীক্ষা। নির্বাচন যত বেশি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে রাষ্ট্রচর্চার দূরত্ব তত কমবে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময়ের শাসনামলে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করেছে। ধ্বংস করেছে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা। দুর্নীতিকে তারা আদর্শায়িত এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। হাজার হাজার কোটি টাকা তারা লুট করেছে এবং সেই টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ওই সময় মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। বিরোধী মত দমন করা হয়েছে পৈশাচিক উপায়ে। এ লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছিল আয়নাঘর। কিন্তু সবকিছুরই একটা শেষ আছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চব্বিশের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। গণহত্যার মাধ্যমেও তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। মানুষের মনোজগতে এখনো জীবন্ত ফ্যাসিস্ট হাসিনার বুলেটকে স্বাগত জানাতে বুক চিতিয়ে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের প্রতিবাদী মুখ। রাস্তায় কান পাতলেই এখনো শোনা যায় শহীদ মুগ্ধর পানি বিতরণের অস্পস্ট আওয়াজ। এখনো হাওয়ায় মিলে যায়নি দেড় সহস্রাধিক শহীদের স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস। তাদের আর্তনাদ আর আহাজারিতে বারবার কেঁপে উঠছে আল্লাহর আরশ। পুলিশের গুলিতে হাত, পা, চোখ হারিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী অগণিত বীরযোদ্ধা দুর্বিষহ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছেন। আয়নাঘরে পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হওয়া হতভাগ্যদের ঘোর এখনো কাটেনি। গুম হয়ে যাওয়া সন্তানরা ফিরবে বলে মায়েরা এখনো পথ চেয়ে আছেন। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় অগণিত মানুষ পথচলতি অজানা-অচেনা মানুষের দিকে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে তাদের গুম হয়ে যাওয়া স্বজনের খোঁজে। শহরের দেয়ালে পাল্টে যাওয়া গ্রাফিতিগুলো এখনো মুক্তিকামী মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে অর্থবহ করে তুলতে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে প্রতিহত করতে হবে। এ ব্যাপারে দেশপ্রেমিক সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে নির্বাচনী সংস্কৃতি। নির্বাচনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে ক্ষমতার পালাবদল। তবেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।
সবশেষে বলা যায়, এবারের বিজয় দিবস আমাদের সামনে একটি নৈতিক আয়না ধরে রেখেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সেই আয়নায় নিজেদের গণতান্ত্রিক অবস্থান দেখার সুযোগ। ইতিহাসের দায় এড়িয়ে নয়, বরং ইতিহাসের আলোয় পথ চলাই এখন সময়ের দাবি। বিজয়ের চেতনা তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন নির্বাচন হবে সত্যিকারের জনগণের উৎসব আর রাষ্ট্র হবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। আমাদের পাঠক, লেখক, শুভানুধ্যায়ীসহ পুরো দেশবাসীর প্রতি রইল মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
মন্তব্য করুন