

রাষ্ট্রীয় গুম বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়গুলোর একটি। দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সংঘটিত গুমের অভিযোগ রাষ্ট্র, সমাজ ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেই প্রেক্ষাপটে গত ১ ডিসেম্বর সরকার যে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করেছে, তা নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। এ অধ্যাদেশ জারির অর্ধমাসের মধ্যেই অধ্যাদেশ সংশোধনের উদ্যোগ এবং বিশেষ করে পাঁচ বছর গুম থাকলে ভুক্তভোগীকে মৃত অনুমানের বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিশেষ বিধান যুক্ত করা হচ্ছে মূলত ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর বাস্তব সমস্যার কথা বিবেচনা করে। সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক হিসাব ব্যবহার, ওয়ারিশ সনদ এবং জীবিকা নির্বাহের প্রশ্নে বহু পরিবার বছরের পর বছর আইনি অচলাবস্থায় আটকে থাকে।
১৯৭৬-৮৩ সালের সামরিক শাসনামলে আর্জেন্টিনায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গুম হয়। বহু পরিবার ২০-৩০ বছর পরও মৃত ঘোষণা করতে রাজি হয়নি। পরে রাষ্ট্র আইন সংশোধন করে মৃত ঘোষণা ছাড়াই। ক্ষতিপূরণ, সম্পত্তির অধিকার এবং সন্তানদের পরিচয় পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেয়। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির। বসনিয়া যুদ্ধে নিখোঁজদের ক্ষেত্রে এক-দুই বছরের মধ্যেই মৃত ঘোষণা করা হয়। গণকবর, ফরেনসিক প্রমাণ এবং যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে এটি করা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় তদন্ত, গণহত্যার বিচার চলমান রাখা হয়।
আমাদের দেশে মৃত অনুমানের যে বিধানের কথা বলা হচ্ছে, তাতে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়ে যায়—এই ‘মৃত অনুমান’ কি গুমের অপরাধকে আড়াল করার সুযোগ তৈরি করবে? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে ‘এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ একটি চলমান অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কনভেনশন, যেটিতে বাংলাদেশ গত আগস্টে যোগ দিয়েছে, সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—নিখোঁজ ব্যক্তির ভাগ্য ও অবস্থান জানা না যাওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রের দায় শেষ হয় না। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই অধ্যাদেশে ‘মৃত ঘোষণা’ নয়, ‘মৃত অনুমান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা আইনগতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তৈরি করে। সরকারের দাবি, এ বিধান ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করবে না। কারণ, মৃত অনুমান হলেও তদন্ত, বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। গুমকে চলমান অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং গোপন আটক কেন্দ্র বা ‘আয়নাঘর’ স্থাপনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করা এ আইনের শক্তিশালী দিক। পাশাপাশি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ, বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ১২০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বাধ্যবাধকতা এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষার বিধান আইনের কাঠামোকে দৃঢ় করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠে এসেছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়ের হওয়া প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এ অপরাধগুলোর দায় অস্বীকারের পথ থেকে সরে আসছে।
আমরা মনে করি, গুমের বিচার শুধু অতীতের অপরাধের হিসাব মেটানোর বিষয় নয়; এটি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচরিত্র নির্ধারণের প্রশ্ন। আমাদের প্রত্যাশা, পাঁচ বছর পর মৃত অনুমানের বিধান যেন কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় দায় লঘু করার হাতিয়ার না হয়। এটি হতে হবে শুধু ভুক্তভোগী পরিবারের জীবনধারণ সহজ করার একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা—ন্যায়বিচারের বিকল্প নয়। সরকার, ট্রাইব্যুনাল এবং মানবাধিকার কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে, সত্য উদ্ঘাটন, দায় নির্ধারণ ও বিচার প্রক্রিয়া যেন কোনো অবস্থাতেই থেমে না যায়।
মন্তব্য করুন