

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন আর কোনো একক সমস্যায় জর্জরিত নয়। বাস্তবতা হলো, আমরা এমন একটি সময় অতিক্রম করছি, যেখানে একসঙ্গে বহু সংকট পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে একটি গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। মূল্যস্ফীতি, ঋণঝুঁকি এবং প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি আজ আলাদা আলাদা ইস্যু নয়। এগুলো একে অন্যকে শক্তি জোগাচ্ছে। যখন বাজারে যাই, মধ্যবিত্ত পরিবারের হিসাব দেখি কিংবা প্রান্তিক মানুষের দীর্ঘশ্বাস শুনি, তখন স্পষ্ট হয় যে, অর্থনীতি এখন শুধু পরিসংখ্যানের বিষয় হয়ে নেই। এটি সরাসরি মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এ বাস্তবতায় সমস্যাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে সমাধান পাওয়া কঠিন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহূর্তে কোনো কাল্পনিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে না। এটি একটি তথ্যভিত্তিক এবং বাস্তব সংকট। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের বেশি সময় পার হলেও অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো কাটেনি। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর গভীরতা আরও পরিষ্কারভাবে সামনে এসেছে। রাজনৈতিক রূপান্তরের এ সময়ে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব ছিল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং নির্বাচনের আগে একটি ন্যূনতম আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। এ জায়গায় কিছু অগ্রগতি দেখা গেলেও সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট।
মূল্যস্ফীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। এর আগের মাস অক্টোবরের হার ছিল ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে গত বছরের একই মাসের তুলনায় মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে; ২০২৪ সালের নভেম্বরে এ হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর অর্থ হলো, সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এবং দৈনন্দিন ব্যয়ের চাপ এখনো উচ্চপর্যায়ে থাকায় যাদের আয়ের বড় অংশ খাদ্যে ব্যয় হয়, সেই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর চাপ প্রকৃত অর্থে কমেনি। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে থাকায় মানুষের প্রকৃত আয় ক্রমেই কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণেও এ বাস্তবতা উঠে এসেছে।
রাজস্ব খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় কিছুটা বেড়েছে, তবে কর জিডিপি অনুপাত নেমে এসেছে প্রায় ৭ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্নের কাছাকাছি। ২০১৫ সালে এ অনুপাত ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। সিপিডি ও আইএমএফ উভয়ই বলছে, এ পতন রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতার জন্য বড় হুমকি। রাজস্ব কমে গেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় সংকুচিত হয় এবং ঘাটতি মেটাতে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ে।
এ বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা মূল্যায়ন করলে বলা যায়, তারা ধস ঠেকাতে পেরেছে, তবে পুনরুদ্ধারের ভিত শক্ত করতে পারেনি। কমিশন, রিপোর্ট ও আলোচনা হয়েছে অনেক, কিন্তু কাঠামোগত সংস্কারের দৃশ্যমান ফল সীমিত। রাজনৈতিক ম্যান্ডেটের সীমাবদ্ধতা এখানে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির পর যে নির্বাচিত সরকার আসবে, তাদের সামনে কী করণীয়। প্রথমত, রাজস্ব সংস্কারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নতুন করদাতা শনাক্ত, ভ্যাট আদায় নিশ্চিত এবং কর প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা ছাড়া বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতে বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আইনের শাসনের বার্তা স্পষ্ট হয়। তৃতীয়ত, সুদহার, জ্বালানি ও বিনিময় হার নিয়ে একটি স্পষ্ট মধ্যমেয়াদি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় না থাকেন। চতুর্থত, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা ও ভোক্তা সুরক্ষা আইন কার্যকর না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এ অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পাশাপাশি নতুন সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে বহির্বিশ্বের পরিবর্তিত বাস্তবতার দিকে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন আগের মতো সরল ধারায় এগোচ্ছে না। কভিড পরবর্তী সময়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য দ্বন্দ্ব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। বড় বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান একক দেশনির্ভর উৎপাদন কাঠামো থেকে সরে এসে বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজছে। এ প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া নতুন উৎপাদন অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ। বাংলাদেশ যদি কৌশলগতভাবে এ পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, তাহলে বৈশ্বিক উৎপাদন ও বাণিজ্য ব্যবস্থায় দেশের অবস্থান আরও শক্ত করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতির ধারাবাহিকতা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বার্তা। নতুন সরকার যদি বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রনীতিকে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ শ্রমনির্ভর দেশ থেকে ধীরে ধীরে আঞ্চলিক উৎপাদন অংশীদারে রূপ নিতে পারবে। এ প্রেক্ষাপটে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উদ্যোগটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আসিয়ান মানে প্রায় ৬৭ কোটি মানুষের একটি বিশাল বাজার, যেখানে কম শুল্ক, সহজ বাজার প্রবেশাধিকার এবং শক্তিশালী উৎপাদন নেটওয়ার্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হলে রপ্তানিনির্ভরতা এক বা দুটি বাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ওষুধ, কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, হালকা প্রকৌশল এবং তথ্যপ্রযুক্তি সেবার নতুন সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া আসিয়ান দেশগুলোতে মজুরি ও উৎপাদন ব্যয় বাড়তে থাকায় অনেক শিল্প বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খুঁজছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ এ স্থানান্তরিত বিনিয়োগের একটি অংশ আকর্ষণ করতে পারবে। এতে রপ্তানি আয় বাড়বে, প্রযুক্তি স্থানান্তর ঘটবে এবং দক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হলে বাংলাদেশের অবকাঠামো ও লজিস্টিক খাতের গুরুত্বও বাড়বে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর জাতীয় সীমা ছাড়িয়ে আঞ্চলিক ট্রানজিট ও সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল হিসেবে বাংলাদেশ যদি এ ভূগোলগত সুবিধা কাজে লাগাতে পারে, তাহলে পরিবহন, গুদামজাতকরণ এবং সহায়ক সেবা খাতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যের বিষয় নয়। এটি সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন। নতুন সরকার যদি অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পাশাপাশি আসিয়ান এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ শুধু সংকট কাটিয়ে উঠবে না, একটি নতুন অর্থনৈতিক অবস্থানও তৈরি করতে পারবে।
সবশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশ এখনো সম্ভাবনা হারায়নি। তবে এ সম্ভাবনা আর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাস্তবায়িত হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন ও জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই। অন্তর্বর্তী সরকার কিছু জরুরি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে, তবে কাঠামোগত সংস্কারের মূল দায় থাকবে পরবর্তী সরকারের ওপর। ২০২৬-এর পর নির্বাচিত সরকার যদি এ সময়কে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটি শুধু আরেকটি ব্যর্থ সরকার নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি হৃত সুযোগ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
লেখক: ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব
মন্তব্য করুন