সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ। এই দিনে মার্কিন মুল্লুকের প্রভাবশালী সিনেটর বব মেনেনডেজ এবং তার স্ত্রী নাদিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল। এ অভিযোগে উভয়কেই অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের অভিযোগ এটাই প্রথমবার নয়। দ্বিতীয়বারের মতো সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান মেনেনডেজ এ ধরনের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছেন।
নিউইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টের ইউএস অ্যাটর্নি অফিসের অভিযোগ অনুসারে মেনেনডেজ এবং তার স্ত্রী নিউজার্সির তিন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে স্বর্ণ, নগদ টাকা, একটি বিলাসবহুল বাহন এবং অন্যান্য উপায়ে কয়েক হাজার ডলার ঘুষ নিয়েছেন। এ ‘অনুদান’ গ্রহণের বিপরীতে নিউজার্সির এই ডেমোক্র্যাট তার ক্ষমতার অবস্থানটি তিন ব্যবসায়ীকে ব্যবহার করতে দেন। এর পাশাপাশি মিশরের সরকারকে লাভবান করার জন্য তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তবে এ ক্ষেত্রে মিশর এমন এক ব্যক্তির দেশ, যে ব্যক্তিটি একজন প্রশ্নবিদ্ধ মানুষ। কথায় বলে দুর্নীতিবাজরাই ক্ষমতাবান হয়ে থাকেন। দুর্নীতি নিয়ে মার্কিন পৌরাণিক কাহিনি আবার এক ভিন্ন গল্প শোনায়। সেই কাহিনি অনুসারে দুর্নীতি হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য কম সভ্য দেশগুলোর ব্যবসা। বিশেষ করে, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু এবং যেসব দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং সেসব সুন্দর ও মহৎ জিনিসগুলোর প্রতি যথাযথ প্রতিশ্রুতির অভাব রয়েছে, তারাই মোটের ওপর দুর্নীতিগ্রস্ত।
তবে মেনেনডেজের কারণে কলঙ্কিত মার্কিনি দর্শকদের জন্য এখানে একটি খবর রয়েছে। দুর্নীতি হচ্ছে, বলতে গেলে প্রায় আমেরিকান আপেল পাইয়ের মতো (এবং এ সম্পর্কিত আরেকটি খবর হচ্ছে, মেনেনডেজসহ বা মেনেনডেজ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র মিশরের দমনমূলক ব্যবস্থায় গত কয়েক দশক ধরে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে এবং এ কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা উচিত)।
তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এই পাইতে মেনেনডেজই একমাত্র খারাপ আপেল নয়। ক্ল্যারেন্স থমাসকে ধরুন, মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি। তার দুর্নীতিগ্রস্ত কাজগুলো নিউইয়র্কভিত্তিক অলাভজনক প্রোপাবলিকার মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হয়েছে। একটি সাম্প্রতিক প্রোপাবলিকা (ProPublica-নিউইয়র্কভিত্তিক একটি স্বাধীন ও অলাভজনক নিউজরুম এবং এর মাধ্যমে জনস্বার্থে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা হয়ে থাকে) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘থমাসের অবকাশ যাপনের কার্যক্রমগুলো ঘড়ির কাঁটার মতো তার উপকারভোগীদের মাধ্যমে লেখা হয়েছে। কারণ এরা হচ্ছে সেসব লোক, যারা তার আইনশাস্ত্রকে পরিচালনা করে এমন মতাদর্শ অনুসরণ করে।’
এ প্রতিবেদনে ‘অবসর কার্যক্রম’ নথি অনুসারে আরও বলা হয়েছে যে, অন্তত ৩৮টি অবকাশ, ২৬টি ব্যক্তিগত জেট ফ্লাইট, আটটি হেলিকপ্টার ফ্লাইট এবং বিলাসবহুল রিসোর্টে বিভিন্ন ধরনের ভ্রমণ, খেলাধুলার অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা হয়েছে। বিলিয়নিয়ার রিয়েল এস্টেট টাইকুন হারলান ক্রো, নাৎসি প্যারাফারনালিয়ার একজন উৎসাহী সংগ্রাহক, থমাসের আপাতদৃষ্টিতে চিরন্তন ‘অবসরে’ নোংরা ধনী ডানপন্থি অবদানকারীদের একজন। ক্রো অন্যান্য অনেক সুবিধাও দিয়েছে, যেমন থমাসের নাতনিকে একটি একচেটিয়া প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুলে ভর্তির জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করা। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বরে, প্রোপাবলিকা আরও প্রকাশ করেছে যে, থমাস গোপনে কোচ নেটওয়ার্কের (কোটিপতি কোচ ভাইদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) জন্য একটি দাতা সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। এ সম্মেলন মার্কিন নীতিকে আরও ডানদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল এবং আপনারা মনে হয় জানেন না যে, কোচ কৌশলের অন্যতম একটি হচ্ছে আদালতের সামনে মামলা উপস্থাপন করা, যেখানে থমাস মার্কিন আইনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। অর্থাৎ থমাসের মাধ্যমে মার্কিন আইনকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী প্রভাবিত করে নেওয়া। পুরোনো একটি ধারণা এখনো বিদ্যমান। সেটি হচ্ছে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’। আর এ পুরোনো ধারণার জন্য এত সব অনর্থ। দিনের শেষে এটা প্রতীয়মান যে, যদিও থমাসের বিদ্বেষগুলো কেবল মার্কিন পুঁজিবাদের সঙ্গে, তবে এখানে এক টুকরো গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে অভিজাতদের অত্যাচার বজায় রাখার জন্য একটি পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা। আপনার চিন্তার গভীরতার মতোই।
যুক্তরাষ্ট্রে যে কেউ ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি সোজা মুখে প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে ভাষা নিজেই দুর্নীতির একটি সরাসরি প্রমাণ। সর্বোপরি আপনি এমন একটি দেশে ‘জনগণের দ্বারা শাসন’ করতে পারেন না, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট প্রচারাভিযানের অর্থ বিধিনিষেধ বাতিল করেন এবং এখানে রাজনৈতিক প্রভাব স্বচ্ছভাবে বিক্রয় করা হয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে অপরাধীদের তালিকা প্রস্তুতি চলছে। স্যামুয়েল আলিটো, সুপ্রিম কোর্টের আরেক বিচারপতি, যিনি এই বছর বিলিয়নেয়ার হেজ ফান্ড ম্যানেজার এবং রিপাবলিকান পার্টির বড় দাতা পল সিঙ্গারের কাছ থেকে কিছু অপ্রকাশিত উপহার গ্রহণ করেছেন। এ মর্মে কিছু তথ্য-উপাত্তও প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে ২০০৮ সালে আলাস্কায় একটি বিলাসবহুল ফিশিং ট্রিপে সিঙ্গার ভ্রমণ করেন। এরপর আলিটো সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলায় সিঙ্গারের হেজ ফান্ডের পক্ষে রায় দেন। এ ছাড়া রয়েছে কেন প্যাক্সটন। টেক্সাসের অ্যাটর্নি জেনারেল ১৬ সেপ্টেম্বর একটি ঐতিহাসিক অভিশংসন বিচারে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ঘুষ গ্রহণের। এ ছাড়া তিনি ন্যায়বিচারে বাধা দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ তোলা হয়। আরও রয়েছে জনবিশ্বাসের অপব্যবহার এবং অন্যান্য অপকর্মের অভিযোগ।
এই অভিযোগগুলো টেক্সাসের একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর সঙ্গে অদৃশ্য লেনদেন এবং বিপক্ষবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহারও যুক্ত হয়েছে।
প্যাক্সটন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন সহযোগী এবং ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলকে উল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টায় একজন সক্রিয় কারিগর, পৃথক দুর্নীতির অভিযোগে এফবিআইর তদন্তনাধীন। এ ছাড়া তিনি গুরুতর সিকিউরিটিজ জালিয়াতির অভিযোগে বিচারের মুখোমুখিও হয়েছেন। টেক্সাস সিনেট রাজ্যের শীর্ষ আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। এরপর ট্রাম্প এ ব্যাপারটি উদযাপন করেন। এবং তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নিয়েছিলেন : ‘কেন প্যাক্সটনের বিজয় খুব বড় একটি দারুণ ব্যাপার!!!’
তবে মেরিয়াম-ওয়েবস্টার (Merriam-Webster) অভিধানের অনলাইন সংস্করণে ‘দুর্নীতি’ শব্দের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ‘অসাধু বা অবৈধ আচরণ, বিশেষ করে ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের দ্বারা’। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘অনুচিত বা বেআইনি উপায়ে ভুলের প্রতি প্ররোচিত করা’। এই ডিকশনারি এন্ট্রিতে আরও একটি বিকল্প অর্থ রয়েছে। সেখানে মাত্র দুটি শব্দ রয়েছে—‘ক্ষয়, পচন’। মার্কিন কর্মকর্তারা সব ধরনের ঘুষ কেলেঙ্কারি থেকে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং রাজনীতিতে ডানপন্থি অর্থের উন্মত্ত প্রভাব একটি নৃশংস প্লুটোক্রেসিকে টিকিয়ে রাখে। এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ দৃশ্যটি সত্যিকার অর্থেই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এরকম দুর্নীতি ও অপচয়ের আরও অনেক উদাহরণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক উপকূলে ২০০৫ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা আঘাত হানে। মার্কিন সরকারের এ সময় ২৫ লাখ দুর্গত ব্যক্তিকে সাহায্য দেওয়ার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই ২৫ লাখ উপকারভোগীর ৯ লাখই ছিল ভুয়া। এ ধরনের ভুয়া সাহায্যগ্রহীতারা ত্রাণের প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়ে নানারকমভাবে খরচ করছে বা অপব্যবহার করেছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনের পতনের জন্য ইরাককে সাহায্য দিয়েছিল। সেই অনুদানের প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার অপচয় হয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট চীনের দক্ষিণে পতিতাদের কীভাবে দায়িত্বের সঙ্গে স্বল্পমাত্রায় মদ্যপান করতে হয়, সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অনুদান দিয়েছে। সেই অনুদানের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৬ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অনেক রকম কেনাকাটা করা হয়। সেসব কেনাকাটার মধ্যে সরকারি কেনাকাটাও রয়েছে। কিন্তু সরকারি কেনাকাটার প্রায় অর্ধেকই হয় ভুয়া, না হয় প্রতারণামূলক। এমন নজিরও রয়েছে যে, সরকারি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে জুয়া খেলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে, নেশাদ্রব্য (মদ) কেনা হয়েছে। বান্ধবীদের (রক্ষিতাদের) সোনার গহনার দামও পরিশোধ করা হয়েছে। এমনকি সরকারি টাকায় আয়োজন করা হয়েছে নৈশভোজের। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক নামে একটি অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সে প্রতিষ্ঠানের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে প্রথম অবস্থানে ছিল সুইজারল্যান্ড। এর পরই নাম আসে যুক্তরাষ্ট্রের। মূল কারণ কী ছিল, তা অবশ্য গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।
লেখক : আলজাজিরার কলামিস্ট। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে ভাষান্তর করেছেন আমরিন খান