এক দেবশিশুর কথা কল্পনা করা যাক। আকাশের কাছ থেকে উদারতা শিক্ষা নেওয়ার কথা ছিল তার। বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে সে হয়তো দেখত সকালের সূর্যোদয়। পূর্ণিমা রাতের ভরা চাঁদ তার মনে কোনো প্রশ্নের জন্ম দিত কি না, তা আমাদের জানা হয়নি। কিন্তু কল্পনা করতে পারি, সেই শিশুটি নিজের জগতে ছিল রাজা। বাবার ব্যস্ততা, মায়ের গৃহকর্ম, ভাইবোনদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া দেখে তার শিশুমনেও হয়তো আগামী দিনের স্বপ্ন সঞ্চারিত হচ্ছিল একটু-একটু করে। সেই শিশুটির একটি তিন চাকার সাইকেল ছিল। সেই সাইকেলে ধানমন্ডির রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত সে কোনো কোনো দিন।
তখনকার দিনে ঢাকার রাস্তায় এত গাড়ি-ঘোড়ার চাপ ছিল না। মানুষ তখনো এতটা ব্যক্তিগত হয়ে যায়নি। কাজেই এলাকার বাড়িঘরে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। রাজনৈতিক পরিবারে মানুষের যাওয়া-আসা, তাদের সঙ্গে তার পরিচয়ের পরিধিও নিশ্চয়ই বাড়ছিল। এভাবে বেড়ে উঠতে উঠতে সেই শিশুটি কোনো স্বপ্ন দেখছিল কি না, তা আমাদের অজানা। তবে বলতে পারি, তার মায়াবী চোখ আর নজরকাড়া মুখচ্ছবি সবাইকে আকর্ষণ করত। সেই শিশুটির দুই ভাই তখন যুবক। দুই বোনের মধ্যে কাড়াকাড়ি—কে ভাইকে বেশি আদর করে। পরিবারের কনিষ্ঠজন হওয়ায় সবার আদরের ভাগ পায় সে। এভাবেই বাবার আদর আর মায়ের স্নেহে বেড়ে ওঠা তার। বোনদের চোখের মণি সে। সব শিশুই নিজের মতো করে একটি জগৎ তৈরি করে নিতে পারে। সব শিশুর জন্য পরিবারের সদস্যদের একটি পরিকল্পনা থাকে। থাকে স্বপ্ন। পরিকল্পনা ছিল এই শিশুর পরিবারটিরও, ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নপূরণের পদক্ষেপ হিসেবে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। ক্লাসের সহপাঠীদের পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষকদের নজরও কেড়েছিল এই শিশু। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠছিল সে। হ্যাঁ, নিশ্চিত করেই বলা যায়, নিজের একটা জগৎ ছিল তার। ছিল নিজের রাজ্যপাট, যেখানে সে নিজেই রাজা। সেই শিশুরাজা নিজের রাজ্যে নিজেকে যখন গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে, তখনই তাকে বিদায় নিতে হয় পৃথিবী থেকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিশ্বের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার শিশু রাসেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ সন্তান এই দেবশিশু শেখ রাসেল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক আতঙ্কের মধ্যে ঘুম ভেঙে যায় তার। চারদিকে তখন কেবলই গুলির শব্দ। ঘাতকের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন বাড়ির সব সদস্য। কেউ যখন বেঁচে নেই, তখনো শিশু রাসেল যেতে চেয়েছিল তার মমতাময়ী মায়ের কাছে। তাকে হত্যা করা হবে না, এই অভয় চেয়েছিল সে। কিন্তু অবুঝ শিশু বোঝেনি, ঘাতকের প্রাণে মায়া থাকে না।
অথচ নিতান্ত শৈশবে এ শিশুটিকেও যাপন করতে হয়েছে বন্দিজীবন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার পরিবারের সদস্যদের অন্তরীণ রেখেছিল। ১৯৭১ সালের ৯টি মাস তাকে কাটাতে হয়েছে অবরুদ্ধ অবস্থায়। কিন্তু নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি তার। এরপর দেশ স্বাধীন হলে নিজেদের বাড়িতে তার ফিরে আসা। মা-বাবা-ভাই-বোনদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তখন ভাবিদের আদর। নিজেও খানিকটা বড় হয়েছে সে। ঘরে এসেছে প্রিয় ভাগ্নে। যার সঙ্গে খেলা করেও কিছুটা সময় যায় তার। আমরা যাকে বলি সুখের সাগরে অবগাহন, সেভাবেই তখন কাটছিল তার সময়। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তার এই সুখের সময়। ঘাতকের নির্মম বুলেট বিদ্ধ করে তাকে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রাণ দিতে হয় এ অবুঝ শিশুকে।
কী অপরাধ ছিল শিশু রাসেলের? জাতির পিতার সন্তান—এই কি তার অপরাধ! বঙ্গবন্ধু পরিবারের কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়নি ঘাতকচক্র। তাই বুঝি প্রাণ দিতে হয়েছিল অবুঝ শিশুকেও! একাত্তরের ৯টি মাস যে শিশুটি অন্তরীণ থেকেও নিরাপদে ছিল শ্বাপদসংকুল দেশে; সেই শিশুটিকে প্রাণ দিতে হলো স্বাধীন দেশে—যে দেশের স্থপতি তার বাবা। যে দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে তার বাবার নামে, সেই দেশের বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য একটি শিশুকে হত্যা করে ক্ষমতার অন্ধলোভে। হায় অপরাজনীতি!
বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন কবি সুকান্ত। সব শিশুর জন্য এখনো নিরাপদ নয় এই পৃথিবী। কিন্তু সব মা-বাবা চান তার সন্তান যেন থাকে ‘দুধে-ভাতে’। কিন্তু রাসেল বেঁচে থাকতে পারেনি। একদিন ফুল হয়ে বিকশিত হওয়ার কথা ছিল যার, তার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হয় অকালে। বিশ্বশান্তি দূত হিসেবে যাকে অভিহিত করা হয়, তার নামে রাখা হয়েছিল তার নাম। ঘাতকের গুলি কেড়ে নিয়েছে সেই শিশুর প্রাণ।
রাজনীতিক বাবার সন্তানের নাম রাসেল। বাবা কি চেয়েছিলেন বড় হয়ে তার এই সন্তান হবে বিশ্বশান্তির দূত, হবে খ্যাতিমান দার্শনিকের মতো? সব মা-বাবা নিজেদের অসমাপ্ত স্বপ্ন তাদের সন্তানের মধ্যে দেখতে চান। হয়তো বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাও চেয়েছিলেন তাদের কনিষ্ঠ সন্তানটি হবে বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো বিশ্বখ্যাত দার্শনিক। হবে বিশ্বশান্তির দূত। কিন্তু রাসেল হারিয়ে গেল। রাসেলের দুই বোন বেঁচে আছেন। একজন চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। মাতৃরূপেণ এই দুই বোনের স্মৃতি থেকে তো ভাইয়ের সেই মায়াবী মুখচ্ছবি মুছে ফেলা যায়নি। এখনো দুই বোন ভাইয়ের স্মৃতি রোমন্থন করেন। এখনো হয়তো কল্পনায় আদরে আদরে ভরিয়ে দেন ভাইকে। আহা, আদরের ভাই আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কোনো আবদার করবে না, স্নেহময়ী বোনদের জন্য এ যে কত বেদনার—তা বোঝে শুধু ভাইহারা বোনেরাই। আজ ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্মদিন। আজ সকালে পুবের আকাশ কি লাল হয়েছে রাসেলের রক্ত মেখে? আজ রাতে যে তারার বুটি আকাশজুড়ে ফুটবে, তার ভেতরে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটি কি রাসেলের মুখ হয়ে হাসবে?
যেখানেই থাক সেই দেবশিশু, তার উদ্দেশে বলি, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ—শুভ জন্মদিন রাসেল।
লেখক : সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়াপ্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক
ইমেইল : [email protected]