সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ০২:১৮ এএম
আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ০৮:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিজেকেই হারাল বিএনপি

নিজেকেই হারাল বিএনপি

গত শনিবার (২৮ অক্টোবর) বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আনাড়ি নেদারল্যান্ডসের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরেছে সাকিব আল হাসানের বাংলাদেশ দল। একইদিন দেশের মাটিতে আরও এক বড় খেলা ছিল, রাজনীতির খেলা। সেটা অবশ্য এ খেলার চেয়ে বেশি উপভোগ্য ছিল। আগে থেকেই দেশজুড়ে একটা ভাবনা ছিল, শঙ্কা ছিল, জল্পনা-কল্পনা ছিল—আসলে কী হবে এই দিনে?

একটা সংশয় ছিল এই দিনটি ঘিরে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেমনটা বলেছিলেন যে, সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তা হয়নি। ২৮ অক্টোবর শনিবার বিএনপি কী করে বা করতে পারবে, এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আসলে হয়েছে অনেক কিছুই। একজন পুলিশ সদস্য খুন হয়েছেন, অনেকে মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন। সাংবাদিক হত্যার চেষ্টা হয়েছে, অনেক সাংবাদিক জখম হয়েছেন। ইসরায়েল যেমন হাসপাতালকেও ছাড়েনি, এদিনও হাসপাতালে আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাড়ি ও বিচারপতিদের কোয়ার্টারে হামলা হয়েছে, অডিট ভবনে আগুন দেওয়া হয়েছে, পুলিশ বক্স, পুলিশের গাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়েছে এবং দেশের রাজনীতিতে হরতাল ফেরত এসেছে।

রাজনীতির মাঠের এ খেলায় সরাসরি পরাজিত হয়েছে বিএনপি এবং সেটা হয়েছে এই সহিংস আচরণের জন্য। বরাবরের মতো আরও একবার আন্দোলন প্রত্যাশিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি নেতৃত্ব। অনেক উচ্চাশা তৈরি করে শেষ পর্যন্ত সহিংসতা করে, পুলিশ হত্যা করে, সাংবাদিক পিটিয়ে, গাড়িতে আগুন দিয়ে এবং হাসপাতাল পুড়িয়ে বিএনপি মূলত নিজেকে আরও কোণঠাসা করেছে। একইদিন একই সময় সহিংসতায় পারদর্শী জামায়াতে ইসলামীও সমাবেশ করেছে। কিন্তু সেই সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। বরং বলতে গেলে শনিবার বিএনপি রাজনৈতিক সহিংসতার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমরা যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক সহিংসতা দেখে এসেছি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন কিছু নয়। বিচ্ছিন্নও নয়। আমাদের এখানে আন্দোলন মানেই সহিংস আন্দোলন। আধিপত্য কায়েমের জন্য সহিংসতা। কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিএনপি যে আন্দোলন করেছে, তার চরিত্র ছিল ভয়ংকর। বলা চলে সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স। কিন্তু মাঝে তারা কিছুটা ব্যাকফুটে গিয়ে এখন আবার পুরোনো রূপে ফিরছে বলেই মনে হচ্ছে।

২০১৪ সালে পেট্রোলবোমা হামলার মধ্য দিয়ে এ দেশে প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারার যে নজির দলটি সৃষ্টি করেছিল, এবার সেদিকে নতুন করে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা আছে বলে ধারণা করছি। সাধারণত সাংবাদিকরা সরকারি দল, সরকারি কর্তৃপক্ষসহ প্রভাবশালীদের আক্রমণের শিকার হন, এবার হয়েছেন বিরোধীপক্ষ দ্বারা। একটা বড় কাজ হলো পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করা। এ কাজটি সেই সময়েও হয়েছে। পুলিশের গাড়ি, পুলিশ বক্স সবই পুড়েছে হিংসার আগুনে। আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, সরকারি স্থাপনায় হামলা এ দেশে হয়েছে অতীতেও। কিন্তু কখনো হাসপাতালে হামলা দেখেনি এ দেশের মানুষ। চরম সহিংস পরিস্থিতিতেও অ্যাম্বুলেন্সকে ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি বহু পুরোনো। বিএনপি এবার অ্যাম্বুলেন্সও পুড়িয়েছে। এরশাদ জামানায় বা তারও আগে হরতালে সাংবাদিকদের গাড়ি আক্রমণের শিকার হয়েছে। কিন্তু একদম টার্গেট করে বিএনপিকর্মীরা যেভাবে সংবাদিকদের মেরেছে, সেটা অতীতে দেখা যায়নি। সাধারণত এসব ঝামেলা হয় সরকারি দলের সঙ্গে। বিরোধী দলের কর্মসূচির তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বিরোধী দলের হাতেই সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা একেবারেই নজিরবিহীন। বিএনপিকর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনেও হামলা করেছে, হামলা করেছে বিচারপতিদের কোয়ার্টারেও। সারা জীবন শত শত মিছিল গেছে এ মন্ত্রীপাড়া দিয়ে, কখনো একটা ঢিলও কেউ ছোড়েনি। বিএনপি এবার সেটাও করেছে। বাসভবনের গেট ভেঙে বাড়ির কম্পাউন্ডেও দলের কর্মীরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

সামনে নির্বাচন। বিএনপি এখন চূড়ান্ত আন্দোলন করছে। কিন্তু এটি যতটা না আন্দোলন, তার চেয়ে বেশি এক হিংসাশ্রয়ী লড়াই। সঙ্গে আছে আরও ৩০টি দল। আমরা বুঝতে পারছি যে, সামনের দিনগুলোতে আরও সংঘাত ও হিংসা অনিবার্য। দলমত নির্বিশেষে সবার উচিত গণতন্ত্রের আওয়াজ তোলা। কিন্তু সহিংসতার এমন নজির স্থাপন করে কি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়?

২৮ অক্টোবর ঘিরে যা কিছু হয়েছে, এর ফলাফল বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে। বিএনপিকে আরও চেপে ধরার সুযোগ পেয়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মধ্যেই কিছু নমুনা দেখা যাচ্ছে। রোববার বিএনপির ডাকা হরতালের দিন সকালেই গ্রেপ্তার হয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেনের বাসায় তল্লাশি ও অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘোষণা অনুযায়ী রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে আওয়ামী লীগ। ২৮ তারিখের মতো ২৯ তারিখেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বিএনপি জেলা পর্যায়ে এবং ঢাকায় বড় বড় সমাবেশ করেছে। কিন্তু আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বলতে যা বোঝায় সেটা দেখাতে পারেনি। এর একটা বড় কারণ প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারের করা অবকাঠামোগত সুবিধা পেয়ে মানুষের ভেতর একটা উন্নয়ন স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আন্দোলনের যে সহিংস রূপ মানুষ দেখেছিল, সেটা তাদের কাছে বারবার ফিরে আসে। ফলে একাত্ম না হয়ে সরে যায় তারা। এ কথা সত্যি যে, নির্বাচনী ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়া, জিনিসপত্রের চড়া দামের কারণে জনমনে সরকারের প্রতি ক্ষোভ আছে। কিন্তু মানুষ এটাও জানে যে, সেটার বিকল্প বিএনপি নয়। তাই সাধারণ জনগণ এ ধরনের আন্দোলনে সমর্থন প্রদানের পরিবর্তে সতর্ক অবস্থানে থাকছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফার দাবি নিয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলতে চাচ্ছে। এই ২৮ অক্টোবর ছিল সে পথের সবচেয়ে আলোচিত কর্মসূচি। বিএনপিকে চাঙ্গা রেখেছিল মার্কিন ভিসা নীতি, ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের অতি সক্রিয়তা। পুলিশ হত্যাসহ সামগ্রিক সহিংসতা উল্টো বিএনপিকেই ভিসা নীতির আওতায় বড় করে নিয়ে এসেছে। মার্কিন সমর্থন দলটিকে কতটা বিভ্রান্ত করেছে, সেটা প্রমাণ পাওয়া গেল এক ভুয়া মার্কিন নাগরিককে নিয়ে দলের নেতাদের সংবাদ সম্মেলন। দিনব্যাপী সংঘর্ষের পর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে একটি প্রতিনিধিদল বিএনপি কার্যালয়ে যাচ্ছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন মিয়ান আরাফি নামে এক ব্যক্তি। তার পাশে দেখা যায় বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন এবং সাবেক জেনারেল সোহরাওয়ার্দীকে। অনেক বছর আগে এক হরতালের সময় বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা, পুলিশের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। তার সারা শরীরে রক্তমাখা ছিল এবং রক্ত ঝরছিল। এত রক্ত দেখে অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন, পরে জানা যায় তিনি সারা গায়ে গরুর রক্ত মেখেছিলেন। সেই সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন এবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উপদেষ্টা বলে মিয়ান আরাফি নামে একজনকে হাজির করেন দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সংবাদ সম্মেলনও করেন। কিন্তু মার্কিন দূতাবাস থেকে জানানো হয়, এ লোক বাইডেনের উপদেষ্টা তো নয়ই, মার্কিন প্রশাসনেরও কেউ নন, তাকে কেউ চেনে না। পুরো বিষয়টি নিয়েই হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। দল হিসেবে বিএনপি হাসির খোরাক জুগিয়েছে। আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে যে, দলটির কর্মীদের মধ্যে প্রতিরোধের সাহস ও সক্ষমতা কম। পুলিশ মারমুখী হওয়ার পর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তারা গুটিয়ে গেছে। এমন একটি ফ্লপ আন্দোলনের পর বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে হবে। সরকারকে চাপে ফেলার প্রচেষ্টা ভেস্তে গেছে। দাবির মুখে বর্তমান সরকার পদত্যাগ করবে, এ ভাবনাটা ছাড়তে হবে।

বিএনপি নেতারা বলে এসেছেন যে, তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মাঠে নামেননি। তারা চান সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ও মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা। কিন্তু এ ধরনের আন্দোলনে সফলতা অর্জন করা একটি জটিল কাজ। আন্দোলনে দেশের আপামর জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয় যেটা হয়নি। ফলে কৌশলে ব্যর্থ বিএনপির চলমান এ আন্দোলন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের পূর্ণ সুযোগ পেয়েছে বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, থাকছে যেসব কর্মসূচি

শিক্ষার্থীদের গালি দেওয়ার অভিযোগ শিক্ষকের বিরুদ্ধে

ফরিদপুরে দুদকের মামলায় খাদ্য কর্মকর্তা কারাগারে

বগুড়ায় স্ত্রীর মামলায় স্বামীর জেল-জরিমানা

‘ক্ষমতায় এলে নারীদের নামে ফ্যামিলি কার্ড দেবে বিএনপি’

হাওরে নির্মিত অলওয়েদার সড়কে পর্যাপ্ত কালভার্ট রাখা হয়নি : উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

মুন্সীগঞ্জের গ্রামে ভয়াবহ আগুন

আহত চবি ছাত্রদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে জামায়াত নেতারা

পুলিশ দেখে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই কালোবাজারে ট্রেনের টিকিট বিক্রি, কারাগারে রেলকর্মী

১০

মৌচাষ উন্নয়নে বিসিকের কার্যক্রম নিয়ে সেমিনার

১১

নিশাঙ্কার শতকে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করল লঙ্কানরা

১২

সিটির হারের পর রদ্রির হতাশ স্বীকারোক্তি: ‘আমি মেসি নই’

১৩

ঝড়ো ফিফটি করেও দলকে জেতাতে পারলেন না সাকিব

১৪

টঙ্গীতে ২ থানার ওসি একযোগে বদলি

১৫

তারেক রহমানের নেতৃত্বে গণআকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব : হুমায়ূন কবির

১৬

সোবোশ্লাইয়ের দুর্দান্ত ফ্রি-কিকে আর্সেনালকে হারাল লিভারপুল

১৭

নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার, সম্পাদক হিলালী

১৮

তারেক রহমানকে ঘিরেই রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে চায় বিএনপি

১৯

চীন থেকে ফিরেই নুরকে দেখতে গেলেন নাহিদ-সারজিসরা

২০
X