মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৪:০৩ এএম
আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:১৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের কারণে যেমন ইউক্রেনের ভয়াবহ যুদ্ধও ঢাকা পড়ে গেছে, ঠিক তেমনি দেশের নির্বাচনী আবহের কারণে লক্ষ করার মতো অনেক ঘটনাবলিই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে, চায়ের টেবিলে, ড্রইংরুমে, অফিসে আলোচনার বিষয় বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না, না এলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না, আওয়ামী লীগের নমিনেশন কেমন হলো, নমিনেশন বঞ্চিতদের মনোভাব কী—এসব চিন্তাই জড়ো হয়ে আছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটি অপ্রীতিকর ও অস্বস্তিকর বিষয় উঠে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেটি ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত ফাইনাল খেলা ঘিরে। ভারতের দুয়েকটি মিডিয়াও বিষয়টি প্রচার করেছে, যা থেকে ভারতের জনগণের মধ্যেও নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

এবারের বিশ্বকাপ আসরে অসম্ভব শক্তিশালী দল নিয়ে ভারত অপরাজিত থেকে ফাইনালে পৌঁছে। অন্যদিকে সর্বাধিকসংখ্যক বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়া জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ফাইনালে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে একপর্যায়ে মনে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া বুঝি সেমিফাইনালেই উঠতে পারবে না। তারপরও উঠেছে। এমন এক ফাইনাল খেলায় দেড়শ কোটি ভারতীয়কে জয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে অস্ট্রেলিয়া ট্রফি জিতে নেয়। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে যখন ম্যাক্সওয়েল ২ রান নিয়ে জয় নিশ্চিত করেন, তখন বাংলাদেশের অনেক বড় একটি অংশের মানুষ বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে। ভিডিও চিত্রে বাংলাদেশের দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় এমন কথাও বলতে শোনা গেছে যে, ‘ভারত হারলেই আমরা খুশি’। কার সঙ্গে হারল সেটা বড় কথা নয়। যদিও বাংলাদেশে ভারতেরও একটি সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের গৌণ বলেই মনে হয়েছে। এ ছাড়া ফেসবুক, টুইটার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেখা গেছে, ভারতের পরাজয়ে একশ্রেণির দর্শককে আনন্দ প্রকাশ করতে। তাদের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকমের বেশি বলে মনে হয়েছে।

স্বভাবতই ভারতের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা গেছে। তাদের কাছে এটি অস্বাভাবিক ও হিংসাত্মক মনে হয়েছে। ভারতের পর্যটন শহর দার্জিলিংয়ের একটি হোটেল ঘোষণা করেছে, তারা কোনো বাংলাদেশি পর্যটককে তাদের হোটেলে স্থান দেবে না। ক্ষুব্ধ হয়ে একটি কসমেটিকস কোম্পানি জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে তাদের কোনো প্রোডাক্ট বিক্রি করবে না। ভারতের একটি টেলিভিশনের আলোচকরা আক্ষেপ করে বলেছেন, দেশটির স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সমর্থন দিয়ে জয় এনে দিল, দেশটির লাখ লাখ মানুষ চিকিৎসা নিতে ভারত আসছে, অসংখ্য মানুষ কেনাকাটা ও ভ্রমণের জন্য ভারত আসছে, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিতে আইসিসির তৎকালীন প্রধান ভারতের জগমোহন ডালমিয়া এত বড় সমর্থন দিল, অথচ তারাই আজ ভারতের ক্রিকেট পরাজয়ে এমন অবিবেচিত প্রতিক্রিয়া জানায়!

কিতাবি কথা হলো, যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো দলকে সমর্থন জানাতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমর্থনেরও একটি অলিখিত এথিকস আছে। সেই এথিকস বাংলাদেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভঙ্গ করেছে বলে তারা মনে করছেন। এটা ঠিক, বাংলাদেশের মানুষ খেলাধুলাপাগল। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় সুদূর আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সমর্থকদের কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংবাদে উঠে আসে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ভবনগুলো সব আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকায় সয়লাব হয়ে যায়। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হয় না। কারণ বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ ওই প্রতিযোগিতায় বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। ভারতীয়রাও ওই খেলায় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশের সমর্থক হয়ে ওঠে। কিন্তু খেলাটা যখন ক্রিকেট, তখন কিছু প্রশ্ন থেকে যায় বৈকি।

একটি খেলায় সমর্থক হয়ে ওঠার পেছনেও কিছু সেন্টিমেন্ট কাজ করে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সবচেয়ে বেশি দর্শক সৃষ্টি হওয়ার কারণ, তারা ফুটবলে বহুকাল ধরে বাঘ ও সিংহের ভূমিকায় রয়েছে। ফুটবলের অসংখ্য জনপ্রিয় তারকার জন্ম দিয়েছে এ দুই দেশ। যখন ব্রাজিলকে সাত গোলে হারিয়ে জার্মানি কাপ নেয়, তখন নতুন করে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী জার্মানির সমর্থক বেড়ে গিয়েছিল। আমরা যখন দেখি এশিয়া বা আফ্রিকার কোনো দেশ ভালো খেলছে, তখন অন্য কোনো দেশকে সমর্থন দেওয়া রেখে সেই এশীয় বা আফ্রিকান দলের সমর্থক হয়ে উঠি। গত বিশ্বকাপে সৌদি আরব যখন প্রথম ম্যাচে ভালো খেলে আর্জেন্টিনাকে (২-১ গোলে) হারিয়ে দেয়, তখন রাতারাতি এশিয়ার মানুষরা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় সব মানুষ সৌদি আরবের সমর্থক হয়ে ওঠে। কিন্তু সৌদি আরব সে ধারাবাহিকতা রাখতে না পারায় আবার দর্শকরা ফিরে যায় যার যার প্রিয় দলের দিকে। এরপর ওই বিশ্বকাপেই দেখা যায়, মরক্কো একের পর এক চমক সৃষ্টি করছে। তখন এশিয়া ও আফ্রিকার বাসিন্দারা মরক্কোর সমর্থক হয়ে ওঠে।

অতএব এ সমর্থন এমনি এমনি আসে না। সমর্থনের পেছনে থাকে আঞ্চলিকতা, গায়ের রং এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই সম্প্রদায় ও ভাষাভাষীর বিষয় কাজ করে। অভ্যন্তরীণ ফুটবলেও এক সময় আবাহনী-মোহামেডানের সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র লড়াই ছিল। এটি কোথাও উল্লেখ নেই, কিন্তু আমরা সবাই জানতাম, দেশের প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীর আবাহনীর প্রতি অধিক দুর্বলতা ছিল এবং একটু রক্ষণশীল গোষ্ঠী মোহামেডানকে সমর্থন দিত। এ নিয়ে হয়তো কেউ তর্ক করতে পারেন, কিন্তু এটাই সত্যি। ব্যতিক্রম দু-চারজনের কথা ভিন্ন।

কিন্তু বিশ্বকাপ খেলায় বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার এত সমর্থনের বিষয়টি ছিল অস্বাভাবিক। এর কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। যদি ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ম্যাচ হতো, এমনকি পাকিস্তানের ম্যাচ হতো এবং বাংলাদেশের সমর্থকরা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানকে সমর্থন দিত, তাহলেও ভারতের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো না। সাত হাজার মাইল দূরে অস্ট্রেলিয়া। ভাষাগত মিল নেই, সংস্কৃতিগত কোনো পরিচয় নেই, আন্তর্জাতিক সম্পর্কও খুব স্বাভাবিক পর্যায়ের—এই চেনাজানা আছে টাইপের। দুই দেশের বাণিজ্যও শক্তিশালী নয়, সেখান থেকে পেঁয়াজ, ডাল বা ডিম আসে না। সামান্য কিছু বাংলাদেশি প্রবাসী থাকেন। বরং কিছু নেতিবাচক বিষয় আছে, যা অনেক বাংলাদেশি হয়তো খোঁজ রাখেন না। অস্ট্রেলিয়ায় যেসব পরিবারের পারিবারিক ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার এবং ঘরে দক্ষিণ এশিয়ার ভাষা ব্যবহার করেন, তাদের ৮০ শতাংশ বর্ণবাদের শিকার হন বলে রিপোর্ট আছে। অস্ট্রেলিয়ায় ২৪ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে হয় বাসা ভাড়া দিতে চায় না, অথবা অতিরিক্ত ভাড়ায় বাসা নিতে হয়। এরকম একটি দেশকে সমর্থন দেওয়াটা ভারতীয়দের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক হোক, খারাপ সম্পর্ক হোক, একটি সম্পর্ক তো আছে। ভারতে চিকিৎসা শেষে, পর্যটন শেষে ফিরে এসে কাউকে তো হতাশা প্রকাশ করতে দেখি না। তাই ক্রিকেটে এই বৈরিতায়, অসহিষ্ণুতায় বিব্রত হতে হয়। এবারও আমরা দেখেছি, ক্রিকেটপাগল লাখ লাখ ভারতীয়র সঙ্গে হলুদ জার্সি পরিহিত সামান্য কিছু অস্ট্রেলীয় সমর্থক বসে খেলা উপভোগ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার কেউ চার মারলে লাফিয়ে উঠেছে, ভারতের কোনো খেলোয়াড় আউট হলে লাফিয়ে উঠেছে। লাখ লাখ ভারতীয় দর্শকের একজন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেয়নি। খেলা শেষে ম্যাক্সওয়েল দৌড়ে গেছেন বিরাট কোহলির কাছে। দুজনে বন্ধুত্বপূর্ণ হৃদ্যতায় একে অন্যকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটাই ক্রিকেট। পাশাপাশি মনে আছে, কয়েক বছর আগে ভারতের আইকনিক সমর্থক সুধীর গৌতমকে ঢাকার গ্যালারিতে নাজেহাল হতে হয়েছিল। তা নিয়ে আমাদের বিব্রত হতে হয়েছে। যে যাই বলুন, যে যে দলকেই সমর্থন করুন, এই অসহিষ্ণুতা কোনোক্রমেই একটি দর্শক গোষ্ঠীর কাছ থেকে আশা করা যায় না। আমরা যে দলেরই সমর্থক হই, তার মধ্যে কোনো হিংসাত্মক মনোভাব কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতেও যে বাংলাদেশবিরোধী সমর্থক নেই তা নয়, আছে; তবে সেটা চোখে পড়ার মতো নয় কখনোই। আমাদের যে আচরণ ভারতের অনেক মানুষের চোখে পড়েছে, তা শুধরে ফেলা উচিত। যে যেই দলকে সমর্থন করুক, বিশ্বের কাছে আমরা মানুষ হিসেবে, সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখি। সে ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা আমাদের জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অসহিষ্ণুতা নয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘তারেক রহমান ডাক দিলে নির্বাচনের দাবিতে ঢাকায় লাখো লোক জমায়েত হবে’

সন্ত্রাসে জড়িত ব্যক্তি ও সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা যাবে

মাদকসেবির হামলায় পুলিশের এসআই আহত

লঞ্চে দুই তরুণীকে মারধরের ঘটনায় মামলা

ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ৬ ডাকাত গ্রেপ্তার

দেশের প্রথম বন খেজুর গাছের সন্ধান দিনাজপুরে

ইতালি পালেরমোতে দুই বাংলাদেশি আটক

বিএনপি নেতার বাড়ি থেকে যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

আ.লীগকে বিচারের আওতায় আনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাল গণসংহতি আন্দোলন

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল সোমবার

১০

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় বিশ্বকাপ স্থগিত

১১

ইবিতে ‘ডি’ ইউনিটের ফলাফল ঘোষণা

১২

পা দিয়ে লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন মানিক

১৩

‘কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে সেটা চাঁদাবাজি নয়’

১৪

নাটোরে বিএনপির মতবিনিময় সভায় গুলি ছোড়ার অভিযোগ

১৫

‘হাসিনার সময় ওয়াজ নিষিদ্ধ ছিল’

১৬

হোটেল কর্মচারীর গায়ে গরম মাড় নিক্ষেপ, অতঃপর...

১৭

রাফাল ধ্বংসের বিষয়ে যা বলল ভারতের বিমানবাহিনী

১৮

চাঁদা না পেয়ে চায়ের দোকানে জবি ছাত্রদল নেতার তালা

১৯

ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে দুজনের মৃত্যু

২০
X