আর কে চৌধুরী
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৪৫ এএম
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:০১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান

মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর হিসেবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি হানাদারদের জিঘাংসার প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়। বাঙালি জাতির জাগরণে অগ্রণী ভূমিকার কারণে বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয় সুপরিকল্পিতভাবে। ২৫ মার্চ রাতেই প্রাণ হারান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কজন খ্যাতনামা অধ্যাপকসহ শতাধিক বুদ্ধিজীবী। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ধারাবাহিকভাবে এ হত্যাকাণ্ড অব্যাহত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের মাত্র এক দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে ব্যাপকসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বুদ্ধিজীবী দেশ ও জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, তার মধ্যে আছেন অধ্যাপক জি সি দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সাংবাদিক সিরাজ উদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজাম উদ্দীন আহমেদ, গিয়াস উদ্দীন আহমেদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাহিত্যিক-সাংবাদিক সেলিনা পারভীনসহ নাম জানা-অজানা অনেকে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় মূলত ভূমিকা রেখেছে পাকিস্তানি হানাদারদের এদেশীয় বশংবদরা। আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর মনুষ্যবেশী পশুরা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা না দিলে, তাদের চিনিয়ে না দিলে তারা যে প্রাণ হারাতেন না, তা সহজেই অনুমেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই ঘাতক-দালালরা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে অপরাধীদের শেষরক্ষা হয়নি। বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারের মাধ্যমে। আরও কয়েকজনের জন্য অপেক্ষা করছে ফাঁসির দড়ি। ঘাতক-দালালদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার এ প্রয়াস অভিনন্দনযোগ্য। ’৭১-এর ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতক ও তাদের এজেন্টরা এ বিচার প্রক্রিয়া যাতে বানচালের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ’৭১-এর সব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের দ্রুত বিচার সম্পন্নের মাধ্যমে এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হবে।

বুদ্ধিজীবীরা হলেন জাতির বিবেক। তারা অন্ধকারে আলো জ্বালান। একটি জাতিকে মেধাগত দিক থেকে এগিয়ে নেন। পাকিস্তানিরা ও তাদের বশংবদরা এটিকে অপরাধ বলে ভেবেছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন তাদের প্রতিহিংসার শিকার। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোয় যখন পাকিস্তানিদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখনো জোরেশোরে চলে বুদ্ধিজীবী হত্যা। এমনকি পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দুদিন আগেও বেশ কজন বুদ্ধিজীবীকে চোখ বেঁধে তাদের বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের চোখ ও হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।

পরাধীনতার গ্লানি মুছে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণে আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা। মুক্তির সংগ্রাম আর বিজয় অর্জনের পথেও বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল অসামান্য। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তারা পাকিস্তানিদের মুখোশ খুলে দিতে শুরু করেন এবং পাকিস্তানিদের সীমাহীন শোষণ ও বৈষম্যের নানা দিক তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলেন। তাই তারা পাকিস্তানি শাসক ও তাদের এদেশীয় দোসরদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। ৯ মাস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও খুনিরা যখন বুঝে যায় পরাজয় আসন্ন, তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধা ও মননে পঙ্গু করে দেওয়ার শেষ অপচেষ্টায় নামে। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের ওপর। আর এ কাজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চেয়েও বেশি নির্মমতার পরিচয় দেয় জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীরা এবং তাদের নিয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। কিন্তু তাদের শেষরক্ষা হয়নি। শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।

পরিশেষে বলছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দেশে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল, তার প্রমাণ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো। এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরের প্রজন্মের যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে উদ্যোগী হবেন, তখন তাদের জন্য এসব গণকবর ও বধ্যভূমি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, এতে সন্দেহ নেই। সর্বোপরি দেশের জন্য যারা সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি চিরজাগরূক রাখা জাতি হিসেবেই আমাদের অনিবার্য কর্তব্য।

বড়ই পরিতাপের বিষয়, এ কর্তব্যটি আমরা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারিনি। এখনো দেশের সব গণকবর ও বধ্যভূমি শনাক্ত করা যায়নি। যেগুলো শনাক্ত করা হয়েছে তার সব সংরক্ষণ করা হয়নি। যেগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে তার বেশিরভাগেরই অবস্থা প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিচর্যার ব্যবস্থা না থাকায় বেহাল। ফলে দেশের গণকবর ও বধ্যভূমির সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। জনবসতির সম্প্রসারণ, অবকাঠামো নির্মাণ ও ভূমিদখলের প্রবণতায় দেশের বহু গণকবর ও বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ ছাড়া অনেক জায়গায় গণকবর ও বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ বা সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিয়ে শুধু জায়গাটি শনাক্ত করে এ বিষয়ে নির্দেশিকা দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে অনেক জায়গা বেদখল হয়েছে বা দখলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে বধ্যভূমিগুলো সংস্কারের।

লেখক : রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের উপদেষ্টা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন সামান্তা শারমিন

ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপল সোমালিয়া, সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি

জনতা গ্রুপ-কুয়েত প্রেস ক্লাবের শুভেচ্ছা বিনিময় সভা

লক্ষ্মীপুর-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী আবুল খায়েকে নিয়ে ‘নির্বাচনী ভাবনা’ 

২ ভাইকে কুপিয়ে হত্যা

ফান্ডের টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে তাসনিম জারার বক্তব্য

জামায়াতের সঙ্গে জোটে আপত্তি জানিয়ে নাহিদ ইসলামকে এনসিপির ৩০ নেতার চিঠি 

হত্যাসহ ১০ মামলার আসামি মহিলা আ.লীগ নেত্রী গ্রেপ্তার

পাগলা মসজিদে এবার পাওয়া গেল ১১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা

বিশ্বসেরা কোচের মঞ্চে পর্তুগালের কোচের পিছনে স্কালোনি

১০

এনসিপির ৩ শীর্ষ নেত্রীর পোস্ট, জানালেন নতুন তথ্য

১১

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ৮ম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত

১২

পিরোজপুর-১ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেন যিনি

১৩

কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই : সুপ্রদীপ চাকমা

১৪

ঢাকার মঞ্চে বেগম রোকেয়া

১৫

সংকটকালে দেশ রক্ষায় বিএনপির বিকল্প নেই : রবিউল আলম 

১৬

রাহিতুল ইসলামের নতুন উপন্যাস : এক বাবার দীর্ঘশ্বাস ও নির্মম সত্যের খোঁজ

১৭

জাকির প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ক্রিকেটাঙ্গন, আবেগঘন বার্তায় সাকিব-তামিম-মাশরাফি-শান্ত

১৮

ভোটাধিকার নিশ্চিত হলেই রাষ্ট্রের মালিক হবে জনগণ : হাবিব

১৯

তুহিনকে ধানের শীষের মনোনয়নের দাবিতে বিক্ষোভ

২০
X