ডিসেম্বর। মহান বিজয়ের মাস। ৫২ বছর আগে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এ মাসেই আসে চূড়ান্ত বিজয়। পরাজয় বরণ করে নেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আর পাকিস্তানি বাহিনীর এ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানি শাসকের শোষণ আর বঞ্চনার। নির্যাতন, নিষ্পেষণের কালো হাত থেকে স্বাধীন হয় বাঙালি জাতি।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই সূর্য উদিত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করেছিল ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন।
কোনো দেনদরবার নয়, কোনো অনুগ্রহে নয়; একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর নতমস্তকে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় বরণ করে নেয়। পৃথিবীতে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর এ বিজয়ের মহানায়ক হিসেবে যিনি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ও ভাস্বর হয়ে আছেন, যিনি অকুণ্ঠ অনুপ্রেরণার আধার; তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। বঙ্গবন্ধু মানেই আমাদের অস্তিত্ব। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়েই তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। তিনি জনগণ ও দেশের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে একই সুতোয় গেঁথেছেন। এককথায় দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্যই বঙ্গবন্ধু জলাঞ্জলি দিয়েছেন নিজের স্বার্থকে। বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। উৎসর্গ করেছেন নিজের জীবনকে।
এজন্য বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে কখনো আলাদা করা যায় না। তিনি বাংলাদেশের কারিগর, নির্যাতিত, নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির দিশারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিজয় লাভ, আজকের এ স্বাধীনতা, এ বিজয়ের উল্লাস। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
জীবনে আমরা অনেকভাবেই আনন্দ উপভোগ করতে পারি। কিন্তু মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা যুদ্ধজয়ের আনন্দ উপভোগ তুলনাহীন। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ সবুজ দেশে ৫২ বছর আগে এ মাসে উদিত হয়েছিল বিজয়ের লাল সূর্য। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তিকামী বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সূর্য। যে সূর্য কিরণে লেগেছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত বিজয়ের রং। সেই রক্তের রং সবুজ বাংলায় মিশে তৈরি করেছিল লাল-সবুজের পতাকা।
সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, যে আশা পূরণে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। ৯ মাসের অসহনীয় জঠর-জ্বালা সহ্য করে এ মাসে জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এ মাহেন্দ্রক্ষণ এক দিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে এ জাতির রক্ত ঝরানো সংগ্রামের ইতিহাস। সেই সংগ্রামের মহান সেনাপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা। বাঙালি জাতিসত্তার ধারক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব থেকেই রাজনীতির প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ। বলা যায়, বাঙালিদের মানবাধিকার রক্ষায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তাই তো কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ মানবতার পূজারি বঙ্গবন্ধুর ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ফেডারেশনের সদস্য হয়ে রাজনৈতিক জীবনের গোড়াপত্তন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
উল্লেখ্য, এখান থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র ও মহাত্মা গান্ধীজির সান্নিধ্য লাভ করেন। দুই মহান নেতার রাজনৈতিক প্রভাব বঙ্গবন্ধুর মধ্যে পরবর্তীকালে দেখা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ১৯৫৩ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত। ১৯৫৫ সালে তিনিই প্রস্তাব করেন দলের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে পরিবর্তনের জন্য। (It was due to Mujib’s initiative that in 1955 the word ‘Muslim’ was dropped from the name of the party to make it sound secular—Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh)।
ফলে আওয়ামী লীগ দলটি অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের চরম বৈষম্যমূলক আচরণ ও অবহেলার বিরুদ্ধে ছয় দফা ছিল বাঙালির স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। অবশেষে বাঙালির স্বাধিকার চেতনা ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
বাঙালির স্বাধিকারের ন্যায্য দাবিকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নীল নকশা করতে থাকে। বাঙালি জাতিও গভীর কালো নিকষ আঁধার থেকে জেগে ওঠে। ৭ মার্চ একাত্তরের বিশাল জনসমুদ্র থেকে স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের প্রণেতা বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন—‘মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ১৯৭১ ইতিহাসে অনন্য ভাষণটি অধিকারবঞ্চিত বাঙালির শতসহস্র আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের উচ্চারণে সমৃদ্ধ। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ঊষালগ্নে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, মানসিক প্রস্তুতির সব দিকনির্দেশনামূলক কালজয়ী ভাষণ দেন ৭ মার্চে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণে সারা দেশের মানুষ অভিভূত-উজ্জীবিত হয়েছিল। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যে স্বপ্ন স্বাধীনতার; আখ্যান শুনিয়েছিলেন, যে কাহিনি বঞ্চিতের-শোষিতের। ৭ মার্চ ভাষণ হয়ে উঠেছিল স্বপ্ন থেকে জাগরণের, কাহিনি থেকে বাস্তবে অবতরণের মন্ত্র।
এই দীপ্তময়ী ভাষণে যেন বাঙালি সত্যিকার দিকনির্দেশনা পেয়ে যায়। চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও থেমে থাকে না। সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্তব্ধ করার জন্য মারাত্মক মারণাস্ত্র নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিমা সামরিক বাহিনী বাঙালি নিধনের নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং পরবর্তীকালে তিনি গ্রেপ্তার হন। ফলে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালিরাও রুখে দাঁড়ায়। গর্জে ওঠে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী-সাহিত্যিক, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকার মুক্তি-সংগ্রামে।
বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে উজ্জীবিত হয়ে এ সরকার দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকরা এ সময় গ্রামেগঞ্জে-শহরে-বন্দরে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে নিরীহ জনসাধারণকে। ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট করে জ্বালিয়ে দেয়। মা-বোনদের ওপর পাশবিক নির্যাতন করে। প্রাণ বাঁচাতে সহায়-সম্বলহীন এক কোটি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবু বাঙালি দমে যায়নি। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখে—‘সাবাস বাংলাদেশ! এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়: জ্বলেপুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। এর ফলে দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের অবসান ঘটে। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় এবং জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। ২৪ বছরের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। প্রভাত সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয়, জয় বাংলা বাংলার জয়, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।
লেখক: অধ্যাপক এবং ট্রেজারার, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়