তামের কারমাউত
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৫২ এএম
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিস্তিনিদের মুক্তির রোডম্যাপ

ফিলিস্তিনিদের মুক্তির রোডম্যাপ

গাজায় অমানবিক, বর্বর ও নারকীয় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি ও বাস্তুচ্যুত ঘটছে চূড়ান্ত মাত্রায়। বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের এ নিষ্ঠুর দমনপীড়নকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু এ নৃশংস দমননীতি বা গণহত্যা বিষয়ে ইসরায়েলের কোনোই কর্ণপাত নেই। ফলে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রাম এখন এক গভীর সংকটের আবরণে আটকে গেছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনে সবার যখন একত্রিত হওয়ার সময়, হামাস-ফাতাহসহ দেশটির অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনো তেমন কোনোই লক্ষণ নেই। স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনের জন্য একটি সুসংগত ও বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে যে তারা অক্ষম, এ পরিস্থিতি তারই প্রমাণ। তাদের এই মুহূর্তে যে জিনিসটি সবচেয়ে আগে দরকার, তা হলো—নিজেদের মধ্যকার সবরকমের মতভেদ দূরে সরিয়ে রেখে নিজ জাতির প্রতি তাদের নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে পুনরায় একত্রিত করা। তার জন্য একটি সুস্পষ্ট কৌশল তৈরি করতে হবে। এর জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে, সব মতভেদ, বিরোধ, দলাদলি ভুলে যাওয়া। এ ধরনের কৌশল গাজাকে জাতিগতভাবে রক্ষা করবে, ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞা ও তাদের প্রকাশ্য পরিকল্পনাকেই নস্যাৎ করবে। একই সঙ্গে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার ইসরায়েলি প্রচেষ্টাকেও হটিয়ে দিতে সক্ষমতা অর্জন করবে।

গাজা অঞ্চলের একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে গাজায় চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ফিলিস্তিনি দলগুলোকে একত্রিত করা এবং দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে একটি নতুন রাজনৈতিক পথ উন্মোচনের দারুণ সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। আর পথের হদিস করতে হলে এবং আমাদের এ জাতিকে ন্যায়বিচার, শান্তি ও নিজেদের রাষ্ট্র কায়েমের দিকে প্রত্যক্ষ পথে নিয়ে যেতে হলে, ফিলিস্তিনি নেতাদের প্যাঁচঘোঁজ ছাড়া ১০টি সোজাসাপ্টা পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আমি মনে করি তা নেওয়া উচিত—

এক. সর্বপ্রথম সব ফিলিস্তিনি দলকে ইসরায়েলের কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দি এবং গাজায় ইসরায়েলি বন্দি বিনিময়ের জন্য কাতারের মধ্যস্থতায় যে চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির পরিপূর্ণতা ও চূড়ান্ত সম্প্রসারণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া উচিত।

দুই. হামাসের উচিত ২০১৭ সালে কায়রোতে স্বাক্ষরিত ফাতাহ পুনর্মিলন চুক্তির স্বীকৃতি এবং প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা। হামাসকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গাজায় দায়িত্ব গ্রহণ করার আহ্বান জানাতে হবে এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) স্বাক্ষরিত গাজায় সব চুক্তিতে প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাসের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনা মোকাবিলা করতে ফিলিস্তিনি নেতাদের এ অঞ্চলের টেকনোক্র্যাটদের সমন্বয়ে স্ট্রিপের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নিং কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। পুলিশসহ গাজার অতীতের সব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মীদের আহ্বান জানাতে হবে তাদের দায়িত্বে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে। এই পরিকল্পনায় পুলিশসহ বেসামরিক হামাসের কর্মীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হামাস যোদ্ধা এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বাহিনীতে অস্ত্রের পুনঃএকত্রীকরণের বিষয়টিও বিবেচনাধীন থাকতে হবে।

তিন. হামাসের উচিত ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মধ্যে স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিকে শান্তি প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে স্বীকার করা। এ ক্ষেত্রে এক বছরের মধ্যে পুরো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের জন্য নির্বাচনের সময়সূচিতে সম্মত হওয়ার পথ খোলা রাখতে হবে। বিনিময়ে ইসরায়েলকে সম্মত হতে হবে সংস্কার হওয়া হামাসকে একটি মূলধারার ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করা। পাশাপাশি ভবিষ্যতে সমঝোতার প্রশ্নে ফিলিস্তিনের মূলধারার রাজনৈতিক দল বা পক্ষ হিসেবে হামাসকে স্বীকৃতি দিতে ইসরায়েলকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

চার. পিএলওকে পুনরায় সক্রিয় হতে হবে এবং এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যেন এ কাঠামো সব ফিলিস্তিনি দল ও ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। বিশেষভাবে জোর দেওয়া উচিত তরুণ ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষের ক্ষমতায়ন, সংগঠনের মধ্যে তাদের আনুষঙ্গিক ভূমিকা গ্রহণ এবং তাদের বোঝাতে হবে যে, তারাই ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ। সংস্কার করা পিএলওতে শুধু ফাতাহ, হামাস এবং অন্যান্য পিএলও উপদলই নয়, ফিলিস্তিনি প্রবাসী প্রতিনিধিদের পাশাপাশি সারা দেশ থেকে স্বাধীন প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে প্রতি চার বছর পরপর সংগঠনের সদস্যদের পুনর্নির্বাচিত করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এটি সর্বসম্মত হতে হবে, যেখানে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনি জনগণের কল্যাণে সংগঠনের বক্তব্যই হবে চূড়ান্ত।

পাঁচ. আন্তর্জাতিক ও আরব তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে গাজার পুনর্গঠন শুরু করা উচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ প্রকল্পের অর্থায়নে অবদান রাখা উচিত আর ফিলিস্তিনে ধ্বংসের জন্য দায়ী দখলদার শক্তি হিসেবে আর্থিক বোঝা ইসরায়েলের ওপর চাপানো উচিত। গাজার টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুনর্গঠনের সব প্রচেষ্টা চালু করতে হবে। জল ও বিদ্যুৎ ঘাটতি, মাছ ধরার এলাকা সংকুচিত করা এবং কৃষিজমির ধ্বংস ইত্যাদি দখলের ফলে স্ট্রিপের পরিবেশগত সম্পদের দ্রুত ক্ষয় মোকাবিলা করাই পুনর্গঠনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ছয়. ইসরায়েলের যুদ্ধ, আগ্রাসন, দখলদারিত্বের শিকার ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয় পরিবারগুলোর জন্য একটি ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠন করতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলো যেমন রাশিয়াকে ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সামনে এনেছে এবং এজন্য ইউক্রেনকে রাশিয়ান হিমায়িত সম্পদ ব্যবহার করে পুনর্নির্মাণ ও পুনর্গঠনের কথা বলেছে; একইভাবে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে জোরালো অবস্থান নিতে যেন একই দায় ইসরায়েলের ওপর চাপানো যায়।

সাত. সংঘর্ষ এড়াতে ইসরায়েলের সীমান্তে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মোতায়েন করতে হবে। তুরস্ককে এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ তারা ফিলিস্তিনিদের কাছে একটি আস্থাভাজন মধ্যস্থতাকারী এবং একই সঙ্গে ন্যাটো সদস্য হিসেবে তার রয়েছে পশ্চিম ও ইসরায়েলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক।

আট. গাজার অবরোধ প্রত্যাহার করতে হবে; সম্পূর্ণরূপে ও নিঃশর্তভাবে। সীমান্ত ক্রসিং, বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলো পুনরায় চালু করতে হবে। পাশাপাশি এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের চলাচলের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে একটি স্থায়ী এবং নিরাপদ উত্তরণ বা চলাচলের পথ স্থাপন করতে হবে। পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য সামুদ্রিক ও আকাশপথ স্থাপনের মাধ্যমে গাজাকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রেও তুর্কি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

নয়. ইসরায়েলকে অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে তার সব দখলদারি কার্যক্রম বন্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ভিত্তি হিসেবে রাখতে হবে ১৯৬৭ সালের সীমানা রেখা চুক্তি (এটি ছিল বহুল আলোচিত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধান চুক্তি। এটি গ্রিনলাইন নামেও পরিচিত। এই সীমানা রেখা অনুযায়ী সীমান্ত নির্ধারণে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা করতে হবে এবং একে অন্যকে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ায় সম্মত হতে হবে)। যা হোক, এ সীমানা রেখা চুক্তিকে ভিত্তি ধরে তিন বছরের সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ঘটাতে শুরু করতে হবে জোরালোভাবে সমঝোতার আলোচনা। আবার আরব লীগেরও উচিত ২০০২ সালের আরব শান্তি উদ্যোগের জন্য চাপ অব্যাহত রাখা। সে সময় এ শান্তি উদ্যোগ সব আরব রাষ্ট্রকে ১৯৬৭ সালের সীমানা রেখা চুক্তি অনুযায়ী একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ককে স্বীকৃতি জানাতে ও স্বাভাবিক করতে আহ্বান জানানো হয়। এ চুক্তি অনুযায়ীই প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ার কথা পূর্ব জেরুজালেম।

দশ. অবশেষে যদি টেকসই, শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ সহ-অস্তিত্ব বা সহাবস্থানের দিকে এ রাজনৈতিক ট্র্যাক ব্যর্থ হয় অথবা বিশেষ কোনো বাধার সম্মুখীন হয়, তবে সংস্কার হওয়া পিএলওকে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের নিয়ন্ত্রণে রাখাই অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র পরিচয় হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। যাতে করে এ অস্তিত্ব বা পরিচয়ই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করতে পারে এবং ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামের স্বাভাবিক প্রকৃতি বা ধরনকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে পারে।

লেখক: ফিলিস্তিনের গাজা অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের পাবলিক পলিসির সহকারী অধ্যাপক। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। জননীতি বিশ্লেষণ, সুশাসন, জনপ্রশাসনের সংস্কার, বৈদেশিক সাহায্য এবং সংঘাত সমাধান তার গবেষণার দিক। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন সঞ্জয় হালদার

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কেউ ছাই দেওয়া হাত থেকে বের হতে পারবে না : উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন

বাংলাদেশে তিন বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশে

রুট ১৩ হাজার রান ছুঁতেই মুখ খুললেন শচীন

‘উপদেষ্টা মাহফুজের ওপর হামলা হয়নি, কনস্যুলেট অফিস ভাঙচুর হয়েছে'

১৫০ টাকায় দেখা যাবে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস টি-টোয়েন্টি ম্যাচ

সাব্বিরকে পাঁচ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ বিসিবির আকুর

জিয়ার সমাধিতে ডা. সাবরিনার শ্রদ্ধা, যুবদল সভাপতির ক্ষোভ

শাহীনুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিতর্ক, অর্থপাচার বিরোধী অভিযানে চাপ

অভিনেত্রী জাহানারা ভূঁইয়া মারা গেছেন

ঢাকা শিশু হাসপাতাল শাখা ড্যাবের নতুন দায়িত্বে ডা. ফারুক

১০

এনসিপির আরও চার নেতার পদত্যাগ 

১১

হাইকোর্টের বিচারপতি হলেন সারজিসের শ্বশুর লুৎফর রহমান

১২

ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণার বিধিমালা প্রকাশ

১৩

হাসনাতকে ‌‘ফকিন্নির বাচ্চা’ বললেন রুমিন ফারহানা

১৪

বিজিবির কাছে ৫ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করল বিএসএফ

১৫

চুরির অভিযোগ, গণপিটুনিতে যুবক নিহত

১৬

সংবিধানের মূলনীতি থেকে আমরা সরে যাচ্ছি : ড. কামাল হোসেন

১৭

রাকসু নির্বাচনে ভোটাধিকারের দাবিতে নবীন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৮

চট্টগ্রামের মিষ্টি কারখানায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, মধুবন ফুডকে জরিমানা

১৯

আশুলিয়ায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

২০
X