শুক্রবার, ২৯ আগস্ট ২০২৫, ১৪ ভাদ্র ১৪৩২
ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:১৭ এএম
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাক্ষেত্রে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার অবদান

শিক্ষাক্ষেত্রে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার অবদান

হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষক, শিক্ষা সংস্কারক, শিক্ষা প্রশাসক এবং একই সঙ্গে সাধক। তিনি পূর্ব বাংলার খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে বেশিরভাগ সময় লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। কলকাতার লন্ডন মিশন সোসাইটি স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং চাকরিজীবন শুরু করেন পূর্ব বাংলায় রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলে সুপার নিউমারারি টিচার হিসেবে। তারপর তিনি পূর্ব বাংলার নানা প্রান্তে শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিপিআই এবং ডিপিআই হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বেশিরভাগ সময় কাজ করেছেন চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা এলাকায়। এ সময় তিনি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কত স্কুল যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সেটা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। কলেজ গড়ার ক্ষেত্রেও তার অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ গড়ার সময় তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এ কলেজেই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়াশোনা করেছেন। এ কলেজের বেকার হোস্টেলটিও গড়ার জন্য তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন এবং সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়।

ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার লক্ষ্যে যে নাথান কমিশন তৈরি হয়েছিল, তার একটি সাব-কমিটির সদস্য ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট তৈরি করার জন্য ৯ সদস্যের যে কমিটি করেছিল, সেই কমিটিরও তিনি একজন সদস্য ছিলেন। তিনি আজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করেছেন। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন। সেই সময়টায় পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও অর্থনীতি অনেক অনগ্রসর ছিল। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা ছিল প্রকট এবং এ সময়টি তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলায় সত্যি সত্যি যদি উন্নয়ন করতে হয়, যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হয়, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এজন্য পূর্ব বাংলায় অসংখ্য মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম এবং শিক্ষাক্ষেত্রেও তিনি অনেকগুলো আমূল সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন একসময় আইএ, বিএ ও এমএ সব পরীক্ষায় আগে নাম লেখা হতো। নাম লেখা থাকলে হিন্দু ও মুসলিম বৈষম্য সৃষ্টি করার সুযোগ ছিল। সুতরাং তিনি প্রস্তাব করলেন পরীক্ষার খাতায় নাম থাকবে না। শুধু রোল নাম্বার থাকবে এবং এ সংস্কারটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক সংস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার যে মধ্যবিত্ত, সেই মধ্যবিত্ত গড়ে তোলার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেল তখন এই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ নিরসনের জন্য ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাও (র.) ছিলেন। আরও ছিলেন নওয়াব আলী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও স্যার সলিমুল্লাহ। তাদের সঙ্গে মিলে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বহুমাত্রিক কাজ করেছেন। আর আমরা তো জানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীকালে আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। সুতরাং এ বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন।

তিনি শুধু শিক্ষাসংস্কারক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন ভালো লেখকও। অসংখ্য বই লিখেছেন এবং অন্যের অসংখ্য বইও প্রকাশ করেছেন তার প্রকাশনী থেকে। তিনি মখদুমী লাইব্রেরিটি স্থাপন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তার আহ্ছানউল্লা বুক হাউস লিমিটেড থেকে আমাদের দেশের অসংখ্য বিখ্যাত উপন্যাস যেমন আনোয়ারা, বিষাদ সিন্ধু, কাজী নজরুল ইসলামের জুলফিকার, বনগীতি, কাব্যে আমপারা; আবু জাফর শামসুদ্দীনের পরিত্যক্ত স্বামী তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এসব বই প্রকাশ করে এই পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মানস গঠনে ও মুসলিম সাহিত্যচর্চায় আধুনিকতা এবং সমাজলগ্নতা আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

এ সময়টায় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) তার সুখ্যাত প্রতিষ্ঠান আহ্ছানিয়া মিশন নিজ গ্রাম সাতক্ষীরার নলতায় শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আমরা সবাই জানি প্রতিষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ। একলা মানুষ টুকরা মাত্র। কিন্তু অনেকে মিলে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি উন্নয়ন করা যায়। সেই বিচারে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখনো তা করে যাচ্ছে।

আমি গভর্নর হিসেবে যখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সঙ্গে জড়িত ছিলাম তখন দেখেছি আহ্ছানিয়া মিশনের ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমি তাদের উৎসাহিত করেছি। আমার জানামতে, খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ খুবই গুরুত্ব দিয়ে এ হাসপাতালটি গড়ে তোলার জন্য তার নিজের পূবালী ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংককে উৎসাহিত করেছেন। এ ছাড়া আহ্ছানিয়া মিশন সমাজের নানা ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাজ করছে। সুতরাং এই শিক্ষাবিদ, এই সংস্কারক খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এ পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মনে গেঁথে আছেন। সেজন্য তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন। বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মরণোত্তর পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন। তা ছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার অর্জন করে।

তাই খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাকে বরাবরই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তিনি সেই সব জায়গায় কাজ করেছেন, যেখানে কাজ করলে মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলা যায়। শিক্ষাই মানুষের মন ও মননের পরিবর্তন ঘটায়। শিক্ষা ও জীবন আলাদা হতে পারে না। সে কারণেই একটি মানবিক ও অর্থনীতিসমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের জন্য তিনি সবসময় কাজ করেছেন শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষার প্রসারে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য নিরলস কাজ করেছেন। এই কারণে আমাদের এ পূর্ব বাংলায় তার যারা উত্তরসূরি, তারা এখনো তাকে স্মরণ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য এবং সংস্কারের জন্য।

আমি জেনে খুব আনন্দিত যে, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ডিসেম্বর মাসব্যাপী খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে। এ জন্মবার্ষিকী উদযাপন কেন্দ্র করে তার অবদানগুলো সবার সামনে নিয়ে আসতে হবে। এভাবেই আমরা তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন ও তাদের মনে তার ভাবনাগুলো গেঁথে দিতে পারি। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর নৈতিকতাকে আমাদের সমাজ এবং শিক্ষায় আরও বেশি প্রতিফলিত করে তুলতে পারলে এটি হবে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বড় উপায়। কেননা শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নীতিবান ভালো মানুষ গড়ে তোলা। আজীবন তিনি সে কাজটিই করেছেন। আমরাও যেন তার কাছ থেকে এ শিক্ষাটিই গ্রহণ করতে পারি।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে নারীদের জন্য বিশেষ কোটা বাতিল 

আন্তর্জাতিক ফেলোশিপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন ছাত্রদলের ঊর্মি

স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরেছেন খালেদা জিয়া

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারের মায়ের মৃত্যুতে প্রেস ক্লাবের শোক

প্রকৌশলীদের মর্যাদা রক্ষায় আইইবি’র ৫ দফা দাবি

পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়ে আসামি ছিনতাই

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের লিগপর্বের ড্র অনুষ্ঠিত, রিয়াল-বার্সার প্রতিপক্ষ কারা?

সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ভিডিওটি ভুয়া

আজীবন থাকা, কাজ ও ব্যবসার সুযোগ দেবে সৌদি, কত টাকা লাগবে

ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক

১০

এবার যুক্তরাজ্য থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের 

১১

ফিফা কোয়ালিফায়ারে শেষবারের মতো নামছেন মেসি, জানালেন নিজেই

১২

অপারেশন থিয়েটারে রোগীকে রেখে স্বাস্থ্যকর্মীর টিকটক, অতঃপর...

১৩

গকসু নির্বাচন : রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়ন বিতরণ 

১৪

চট্টগ্রামে হবে আইইসিসি মাল্টিডেস্টিনেশন এডুকেশন এক্সপো 

১৫

চব্বিশের বিজয়ীদের কার্যকলাপে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ : কাদের সিদ্দিকী

১৬

ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে হামলার আশঙ্কা নিয়ে যা বললেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

১৭

প্যানেলে তন্বির জন্য পদ শূন্য রাখলেও একই পদে লড়ছেন বাগছাসের এক নেতা

১৮

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের শেষ দুই ম্যাচের জন্য আর্জেন্টিনা দল ঘোষণা

১৯

আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে নতুন রাজনৈতিক জোট

২০
X