ড. ঘাদা আগিল
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১:১২ পিএম
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:১১ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গাজার অনাথ শিশুদের আর্তনাদ কি শুনতে পান

গাজার অনাথ শিশুদের আর্তনাদ কি শুনতে পান

গাজার উত্তরে জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে আহমাদ নামের ১১ বছরের নাবালক বালকের কান্না আকাশ-বাতাসকেও বিদ্ধ করছে। সে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করছে আর বলছে, ‘আমি আমার বাবাকে চাই, আমার বাবার কাছে যাব, আমার বাবাকে...।’ ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হাতে তার বাবার হত্যার ঘটনায় সেখানে যে গভীর শূন্যতা বিরাজ করছিল, তা ভেদ করে আহমাদের বুকফাটা কান্নায় পুরো আশ্রয়শিবির প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

আহমাদ কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘বাবা তুমি কোথায়? তোমাকে ওরা কেন মেরে ফেলল? কী অপরাধ ছিল আমার বাবার? বাবা বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাকে। আমাদের ছেড়ে যাবেন না— এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তোমরা আমাকে একা থাকতে দাও।’

এদিকে বেলজিয়ামে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে আরেক ফিলিস্তিনি বালক, নাম জেইন। ১৫ বছর বয়সী জেইনের বাবা সামির আবুদাকা। তিনি আলজাজিরার ক্যামেরাম্যান। ১৫ ডিসেম্বর ইসরায়েলি ড্রোন আক্রমণে জেইনের বাবা মারা যান। জেইন সেই নিষ্ঠুর ট্র্যাজেডির কথা যেভাবে বর্ণনা করছে, তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।

ড্রোন আঘাতের পর সামিরের পাঁচ ঘণ্টা ধরে রক্তপাত হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণে একসময় তিনি মারা যান। আমি সেই খান ইউনিসের ফারহানাহ হাই স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু রামি বুদেইরসহ একটি অ্যাম্বুলেন্সে তিনজন গিয়েছিল সামিরকে উদ্ধার করতে। তারা তিনজনই নিষ্ঠুরভাবে ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্যবস্তু হয়। তাদেরও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।

জেইন যখন তার বাবার কথা বলছে, তখন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর নৃশংসতার ব্যাপকতা তার অশ্রুসিক্ত চোখ ও মুখে ফুটে উঠেছে। ঈশ্বরের কাছে সে তার বাবার জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা করার অঙ্গীকার করছে। তার বাবাকে নিয়ে সে একটা গান লিখেছে। গানটি গাওয়ার সময় তার কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছে।

সে গাইছে,

‘আমার হৃদয় তোমাকে মিস করছে তোমার বিচ্ছেদ আমায় নিদারুণ কষ্ট দিচ্ছে তুমি চলে যাওয়ার পর আমার হৃদয় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে বাবা, আমার স্বাদইন্দ্রিয় শুধু তিক্ততা বয়ে বেড়াচ্ছে।’

বেলজিয়ামে জেইনের কথা আর জাবালিয়ায় আহমদের কান্নার শব্দ কানাডার এডমন্টনে আমার কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।

আমিও কাঁদছি। তাদের বেদনার চিত্রগুলো আর দেখতে পারছি না। তারা যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করছে, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আমি পুরোপুরি অক্ষম। গত ৮০ দিনে আমার হৃদয় হাজারবার বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় আরও একবার ভাঙল। আমি এ শিশুদের দুরবস্থার চিন্তা থেকে কোনোক্রমেই পালাতে পারছি না। ইসরায়েলি গণহত্যাকারী সেনাবাহিনীর নির্দয় আগ্রাসনে এসব পিতৃ-মাতৃহারা শিশুদের দীর্ঘস্থায়ী ট্রমার মধ্যে ছুড়ে ফেলার চিন্তা থেকে বের হতে পারছি না।

যেটা আমার ব্যথাকে আরও অসহনীয় করে তুলছে, তা হচ্ছে জেইন আমার নিজের ছেলে আজিজের সমবয়সী। বিস্ময়করভাবে তার মুখের গড়ন, উচ্চতা, শরীর, কণ্ঠস্বর এমনকি পোশাক ও চুলের স্টাইল সব দিক দিয়েই আমার সন্তানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই অস্বাভাবিক সাদৃশ্যগুলো জেইন এবং গাজায় বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের হারিয়েছে এমন লাখ লাখ শিশুর প্রতি আমার গভীর দুঃখকে আরও তীব্র করে তুলছে।

আমি যখন জেইন ও প্রেস ভেস্ট পরা অবস্থায় তার বাবাকে হত্যার কথা ভাবছি তখন আমার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আরেক ফিলিস্তিনি এতিম বালক ডনিয়া আবু মুহসেনকে নিয়ে। ডনিয়া খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে সুস্থ হয়ে উঠছিল। সে সময় সামিরের মরদেহ আনা হয়েছিল সেই হাসপাতালে। তাকে কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এর আগে ডনিয়া ও তার পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল যে বাড়িতে, সেখানে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে তার বাবা-মা এবং দুই ভাইবোনকে হারাতে হয়। আর তার পা মারাত্মকভাবে জখম হয়। যার ফলে তার একটি অঙ্গচ্ছেদ করা দরকারও পড়ে।

ডনিয়ার মৃত্যুর কয়েক দিন আগে একটি ভিডিওতে তার চেহারা দেখা যায়। সে যখন ক্যামেরার দিকে তাকায়, তার মুখে একটি ম্লান হাসির রেখা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। সেখানে সে তার বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা ও স্বপ্নের কথা বলে। বলেছিল, সে পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে চায়। ডনিয়া বলছিল, ‘আমার পরিবার ছাড়া আমরা এখন একা। আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে খুব বেশি রকমের যুক্ত ছিলাম। তারপরও আমাকে অবশ্যই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’

কিন্তু ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী তার ইচ্ছা আর স্বপ্নকে খুন করেছে। সামিরকে খুন করার দুদিন পরই তারা ডনিয়াকে হত্যা করে তার স্বপ্নকে খুন করেছে। তারা নাসের হাসপাতালে গোলাবর্ষণ করে এবং হাসপাতালের বিছানায়ই অনাথ মেয়েটি মারা যায়।

আমি অন্য শিশুদের নিয়ে চিন্তা করি, যে শিশুরা এখনো বেঁচে আছে কিন্তু তাদের হৃদয় ও শরীর বিধ্বস্ত, মারাত্মকভাবে আহত, তাদের যত্ন নেওয়া, দেখাশোনা করার জন্য পরিবারের কেউ আর বেঁচে নেই। আরেকজন অল্পবয়সী অনাথ। সেও সম্ভবত ডনিয়ার বয়সী হবে। সে আরেকটি ভিডিওতে তার কষ্টের গল্প শুনিয়েছে। সে তার বাবা-মা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, খালা ও চাচাসহ ৭০ জনের নিহতের বর্ণনা করেছে। তারা সবাই নিজেদের বাড়ি হারানোর পর শ্যালেটে আশ্রয়শিবির খুঁজছিল। শুধু সে আর তার পাঁচ বছরের ভাই কানন বেঁচে গেছে। তারা এখন হাঁটতে পারে না। তাদের জরুরি অপারেশনের প্রয়োজন। তারা অপেক্ষা প্রহর গুনছে এবং প্রার্থনা করছে রাফাহ ক্রসিং কবে খুলবে আর তারা যাওয়ার সুযোগ পাবে।

সে ৫৫ হাজার আহতদের একজন, যারা বর্তমানে গাজাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এবং বলা যায় বিশ্বের কাছে এক প্রকার পরিত্যক্ত হয়ে আছে। মেয়েটি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি সীমান্ত না খুলে, আমি আর হাঁটতে পারব না। আমি তীব্র যন্ত্রণার প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করছি। আমি আমার বাবা-মাকে গভীরভাবে মিস করছি। এমন গভীর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠ আর মুখের অভিব্যক্তি; যা কঠিনতম পাথরকেও ভেদ করতে সক্ষম।

গাজার শিশুরা আজ এক নারকীয় ভয়াবহতা ও দুর্দশার মুখোমুখি। ন্যায়বিচারের জন্য তাদের যে আকুতি, তা নিছক আবেদন নয়, এটি মানবতার কাছে, বিশ্বমানবতার সম্মিলিত বিবেকের কাছে এক আহ্বান। অবশ্য সে বিবেক যদি এখনো বেঁচে থাকে!

গাজায় চলমান গণহত্যাকে আমেরিকা ও তার নেতৃত্ব বলয়ে থাকা শক্তিগুলো প্রকাশ্যে সমর্থন করছে। অথচ তারা চাইলেই এ নারকীয় হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারে। বিস্ময়করভাবে তারা এটাই নিশ্চিত করছে যে, আরও শিশু এতিম হোক, ক্ষুধার্ত হোক, গৃহহীন হোক; দিনরাত বোমাবর্ষণ করা হোক যাতে করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও পিতামাতার যত্ন-আদর থেকে বঞ্চিত হয় এসব শিশু।

চলতি মাসেই রাশিয়ান-আমেরিকান অ্যাকটিভিস্ট মাশা গেসেন তার হান্না অ্যারেন্ডট পুরস্কার প্রাপ্তির সময় বলেছেন, বিশ্বের কাছে গাজা ইস্যুতে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণের এখনো দারুণ সুযোগ রয়েছে। গেসেন এর ব্যাখ্যা তুলে ধরেন ও বিষয়টির ওপর জোর প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘নাৎসি-অধিকৃত ইউরোপে গাজা ও ইহুদি ঘেটোগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, অধিকাংশ গাজাবাসী এখনো বেঁচে আছে এবং এখনো এর সমাধানের সুযোগ রয়েছে বিশ্বের হাতে।’

আমরা যদিও ডনিয়া, জেইনের বাবা-মা, আহমাদ এবং ছোট্ট এতিম বালিকাটির বাবা-মাকে বাঁচাতে পারিনি, তবে যারা এখনো গাজায় বেঁচে আছে, তাদের বাঁচানোর সুযোগ তো রয়েছে। আমরা এখন অবশ্যই একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চাই।

লেখক: কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একজন ভিজিটিং প্রফেসর এবং তৃতীয় প্রজন্মের ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু। নিবন্ধটি আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন সঞ্জয় হালদার

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ থেকে নতুন দামে স্বর্ণ বিক্রি শুরু, ভরি কত

আফগানমন্ত্রীর ভারত সফর ঘিরে কৌতূহল

বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রধান সমস্যা সন্ত্রাস ও দুর্নীতি : রহমাতুল্লাহ

বায়ুদূষণের শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার অবস্থান কত

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস

প্রকৃতির অলংকার অনিন্দ্যসুন্দর সাতডোরা 

৫ অক্টোবর : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

পুলিশের ওপর হামলা করে আ.লীগ নেতাকে ছিনিয়ে নিলেন স্বজনরা

গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহারে রাজি ইসরায়েল : ট্রাম্প

রূপায়ণ গ্রুপে চাকরির সুযোগ, পাবেন একাধিক সুবিধা

১০

প্রেমিকার উপস্থিতিতে প্রেমিকের কাণ্ড

১১

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

১২

বাংলাদেশের ম্যাচসহ টিভিতে আজকের যত খেলা

১৩

ঢাকায় কখন হতে পারে বজ্রবৃষ্টি, জানাল আবহাওয়া অফিস

১৪

রোববার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৫

৫ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৬

মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি, ক্লু পাচ্ছে না পুলিশ

১৭

পাতানো জালে আটকা নিখোঁজ বৃদ্ধের লাশ

১৮

ভারত বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায় না : মুশফিকুর রহমান

১৯

সিলেটে যানজট মোকাবিলায় এনসিপির ২৭ প্রস্তাবনা

২০
X