আজকের রাতটাই অপেক্ষা। আগামীকালের নির্বাচনে কে জিতবে—সেই প্রশ্ন নেই। জানারও বাকি নেই। সেটেল কেস যাকে বলে। অথচ বরাবর নির্বাচনে যত আগ্রহ বা প্রশ্ন থাকে কে হবে বিজয়ী? কারা যাবে সরকারে? এবার এক নতুন চিত্র। যত প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা বিরোধী দল নিয়ে। কে হবে বিরোধী দল? আরও খোলাসা করে বললে, কাকে বানানো হবে বিরোধী দল? ডামিদের ঈগল, অভিমানীদের লাঙ্গল, কোথাও কোথাও ট্রাকের দাবড়াদাবড়িতেও তা পরিষ্কার নয়। ধানের শীষ এই রেসেই নেই। নির্বাচনে না এলেও, বিএনপিই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তারা নির্বাচনে নেই, ভোটের মাঠে আছে। ভোট না দেওয়ার আহ্বান ফেরি করছে। লিফলেট বিতরণ করছে। এ সরকারের অধীনে মানুষ যেন ভোট না দেয়, কেন্দ্রে না যায়—সেই আহ্বানের দাবি বিএনপির। কমজুরি হলেও সেই আহ্বানে অলিগলিতে দৌড়ের ওপর লিফলেট ছাড়ছে। ৭ জানুয়ারি বাড়িতে থাকতে, নইলে শ্বশুরবাড়ি বা কোথাও বেড়াতে চলে যাওয়ার পথ বাতলাচ্ছে। আর হরতাল-অবরোধ-অসহযোগের খেলা তো আছেই। নমুনা কিছুটা ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ের মতো।
সেই দিনটিতে ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগসহ বৃহৎ সব দলই তা বয়কট করে। বিএনপির মিত্র জামায়াতও যায়নি ওই নির্বাচনে। সবার ছিল এক দাবি—দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। আজকের ক্ষমতাসীনরা সেদিন ডেকেছিল আন্দোলনের এক নয়া কর্মসূচি ‘গণকারফিউ’। মানুষকে বলা হয়েছিল কেউ যেন ভোটকেন্দ্রে না যায়। বাড়ি থেকেও বের না হয়। কিন্তু ভোট হয়ে গেছে। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। কেউ ভোট না দিলেও ভোট হয়ে যায়। এখানে ভোট ঠেকানো যায় না। কোনো নির্বাচন অবৈধ হয় না। সব নির্বাচনই বৈধ ও গ্রহণযোগ্য। এক শতাংশ ভোট পড়লেও আইনগতভাবে সেই নির্বাচন বৈধ। কেউ নির্বাচনে না এলেও ক্ষতি নেই, বিনাভোটে বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে বিজয়ী হওয়ার বিধান আছে। তা আজকের ভোট ঠেকানোর আন্দোলনকারী বিএনপিরও জানার বাইরে নয়। যেমন জানত ও জানে আজকের ক্ষমতাসীনরাও।
এরশাদের অধীনে ’৮৬ ও ’৮৮ সালেও তারা এ কাজ করেছে। ’৮৬-তে এ আন্দোলনের একপর্যায়ে বিএনপিকে রাস্তায় একা ফেলে আওয়ামী লীগ-জামায়াত চলে গেছে নির্বাচনে। ’৮৮ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সবাই মিলে ওই নির্বাচন বয়কট করেছে। ঠেকানোর চেষ্টা করেছে, পারেনি। এরশাদের অধীনের ওই নামকাওয়াস্তের নির্বাচনও আইনত বৈধ হয়েছে। গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ওই সংসদ ও সরকার চলেছে। মানি না, মানি না বলতে হয়েছে ওই সংসদ ও সরকারের কাছেই। এ এক নিদারুণ ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের। বিরোধী দলে থাকার সময় এ নিয়ে নানা কথা বললেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর কোনো দলই এর হিল্লা করে না। বরং জিইয়ে রাখে। কারণ ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে এই গোঁজামিলটি বড় মধুময়। তা পছন্দ হয় না বিরোধী দলে গেলে। এমন মশকরার মধ্যেই ভোট ঠেকানোর আন্দোলন করতে হয়, এখনো করে।
এবার একটু ব্যতিক্রম হচ্ছে, তা জানার পরও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গা-ছাড়া নয়। ভোট দুটিরই দরকার মনে করছে তারা। তাই তো পুরোদস্তুর নির্বাচনের মাঠে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার পরও ভোট খুঁজছে। শুধু ভোট নয়, ভোটারদের কেন্দ্রে আনার মিশন নিয়েছে। ভোট আর ভোটার শুনতে এক মনে হলেও এবার এতে অর্থগত তফাত ধরা পড়েছে। প্রার্থীদের দরকার ভোট আর নির্বাচন কমিশনের দরকার ভোটার। নির্বাচনী আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-আরপিওতে ভোটার উপস্থিতি এক শতাংশ হলেও আইনগতভাবে কোনো সমস্যা নেই। তারপরও ভোটার উপস্থিতি ভালো দেখানো জরুরি হয়ে পড়েছে। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব মর্মে জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশন থেকে। ক্ষমতাসীন দল থেকেও প্রার্থীদের তাগিদ দেওয়া হয়েছে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর । দলীয়, স্বতন্ত্র আর ডামি সব প্রার্থীর জন্যই এটি বাড়তি চাপ।
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে এরই মধ্যে প্রার্থী ও দলের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। নিবন্ধিত ২৬-২৭টি অংশ নিয়েছে। প্রার্থীর অংশগ্রহণও ১ হাজার ৮০০-এর ওপর। এর মধ্যে সংখ্যাতত্ত্বে সবচেয়ে বড় সাফল্য বা ক্যারিশমা জাতীয় পার্টির। দলীয়ভাবে তাদের প্রার্থী সবচেয়ে বেশি, ২৮৩। সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২৬৮ জন। আর জাতীয় পার্টির বেশ কিছু প্রার্থী এরই মধ্যে সটকে পড়ার পর এখনো আছেন শ’দুয়েক। ব্যালট পেপারে নাম থাকবে ২৮৩ জনেরই। তা ভবিষ্যতে কাজে লাগতেও পারবে। প্রয়োজনে তাদের এত প্রার্থী দেওয়ার বড়াই দেখাতে পারবে। আর সরকার এখনই দেখাতে পারছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। মানে বহু প্রার্থীর অংশগ্রহণ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুদলের যে কোনো একটি না এলে নির্বাচনটি আক্ষরিকভাবে অংশগ্রহণমূলক হয় না। লেজিটিমিসির ঘাটতি থাকে। তবে বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমস্যা হয় না। এবার বিএনপি না এলেও সুষ্ঠু-প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের শর্ত পূরণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। নমুনাও দেখা দিয়েছিল। নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলীয় ও স্বতন্ত্রদের নিয়েই একটি প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের আবহ দেখা দেয়। ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতার জন্য যথাসম্ভব সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের এ চেষ্টায় তালগোল পেকেছে শেষদিকে এসে। বিএনপির অপূর্ণতা কাটাতে দলীয় লোকদের নির্বাচনে ডামি-স্বতন্ত্র প্রার্থিতার দুয়ার খুলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা তথা অংশগ্রহণমূলক দেখানোর পথের বাঁকে কোথাও কোথাও বেশ বিপত্তি। নির্বাচন করে জিতে আসার সাহস রাখতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে বেশি গোসা করেছে বেশি আসনে প্রার্থী দেওয়ার হিম্মতওয়ালা জাতীয় পার্টি। প্রধানমন্ত্রীর সুষ্ঠু-প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন চাওয়ার বিপরীতে চৌদ্দদলীয় মিত্রদের কয়েকজনও। নৌকার প্রার্থীদের অনেকের যেনতেনভাবে জয়ী হয়ে আসার মাত্রা ছাড়ানো বাসনা। ডামিদের কারও কারও মধ্যে অদম্য আমিত্ব। কেন পাস করানোর গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে না, এমন অভিমান তাদের। মামার বাড়ির আবদারের চেয়েও বেশি। এসব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনবিরোধী। অথচ তারা জাতীয় নেতা, জননেতা। ভোটে জিতে আসার বদলে সরকারের খাস কৃপা বা রিলিফে অটো পাসের এমন আশাবাদী নেতাদের কয়েকজনের প্রতি এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর উষ্মার তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে। টানা ১৫ বছর সরকারের আনুকূল্যে থেকেও দলকে এবং নিজেদের ভোটার সম্পৃক্ত করতে না পারায় তাদের তিরস্কার করেছেন তিনি। এতে লাজশরম পাননি তারা। সেই অভ্যাস নেই তাদের।
বিএনপি সরকারের প্রকাশ্য বা স্পষ্টবিরোধী। তারা শুধু নির্বাচন বয়কট নয় আর, ঠেকিয়ে দিতে চায়। আর আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র, চৌদ্দ দল, জাতীয় পার্টির কিছু প্রার্থী ভোট-ভোটার ছাড়াই ‘মাননীয়’ হতে চান। তাদের মনোজাগতিক এ কুচিন্তা সরকারের জন্য বিএনপির ভূমিকার চেয়েও বেশি শত্রুতার। বিএনপি ভোট-ভোটারে বাগড়া দিচ্ছে। আর সরকারের এ মিত্ররা ভোটেরই সর্বনাশ করছে। ভোট-ভোটারকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনে এবার একটা নতুন মডেল। এবার রাতে নয়, দিনে ভোটের ওয়াদা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ‘অস্ত্রে নয়, রাতের অন্ধকারে নয়, ভোটেই সরকার গঠন হবে’ মন্তব্য। এটিও শুধু মন্তব্য নয়, ওয়াদাও। এ ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচন স্থানিক হলেও আন্তর্জাতিক বিষয়-আশয় যোগ হয়ে গেছে। এ নির্বাচনের পার্ট হয়ে গেছে প্রতিবেশী ভারত, নিকটবর্তী চীন, সুদূরের যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশ। দেশের কোন মহল কী চায় তার চেয়ে কোন দেশ কী চায়, সেই কাঙালপনা ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। কোনো রাখঢাক নেই। কোন দেশ কোনদিকে তা দলে দলে বেলাজের মতো আলোচিত। পথে-ঘাটে-মাঠেও উচ্চারিত। গত অর্ধশত বছরে ভোটের বহু মডেল প্রদর্শন হয়েছে বাংলাদেশে। এখানে গণতন্ত্রের বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েকদলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি মডেল। ভোট আর ভোটারেও এন্তার বারোয়ারি কাণ্ড।
এত কাণ্ডকারখানার মধ্যে এবার প্রার্থীদের কেন্দ্রে বেশি করে ভোটার আনার চাপ দেওয়া কম কথা নয়। এটি বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে অবশ্যই একটি মোটাদাগের ঘটনা। বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা যেভাবে উপেক্ষিত-অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল, এবার সেটাতে ছন্দপতন। আবার ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করার বিষয়ও যোগ হয়েছে। ভোট বয়কট-বর্জনের মধ্যে ভোটে বাধা । ভোট বর্জন-বয়কট বা আহ্বান যার যার গণতান্ত্রিক অধিকার। আগে ভোটারদের বাধা বা হুমকি দেওয়া হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল না। কমিশন নতুন আইন করেছে। আইনে হুমকিদাতাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে। এর ঠিক বিপরীতে ভোটারদের জোর করে ভোট দিতে বাধ্য করা, ভোট না দিলে বা কেন্দ্রে না এলে চরম শিক্ষা দেওয়ার হুমকির আরেক হুকুমজারি। ভোট না দিতে বা দিতে বাধ্য করার এ দুই আজাব আগামীকাল কোন পরিস্থিতির জন্ম দেয়, তা আর মাত্র এক রাতের অপেক্ষা।
লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ; বাংলাভিশন