জেনিনে অবস্থিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির। গত রোববার ইসরায়েলের ড্রোন হামলা চালিয়েছে এ শিবিরে। এ হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিল ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী। সংখ্যায় তারা ছিল হাজারেরও বেশি। প্রায় ১০ হাজার সাধারণ নাগরিকের বসবাসস্থলে চালানো হয় এ হামলা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক আবাসিক ভবন, ধ্বংস হয়ে যায় রাস্তাঘাট। আর যুদ্ধাপরাধের এ ঘৃণ্য ঘটনা সারা বিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
এ ঘটনায় তিন হাজারেরও বেশি বাসিন্দাকে তাদের বাসস্থান খালি করে ফেলতে বাধ্য করা হয়। আর এ ঘটনার জেরে অন্তত ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহতের সংখ্যা ৫০ জনেরও বেশি। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র মন্তব্য করেছে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। কিন্তু দেশটির কর্তাব্যক্তিরা উল্লেখ করেননি, ইসরায়েলের সৈন্যরা অধিকৃত পশ্চিম তীরে দখলদারির মাধ্যমে জেনিনেই তাদের অবস্থান নিয়েছিল। গত মঙ্গলবার সকালে ধ্বংসাবশেষের চরম দুর্দশাপূর্ণ কিছু স্থিরচিত্র এবং ফুটেজ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব ভিডিও এবং ছবিতে দেখা যায়, জেনিন আক্ষরিক অর্থেই পাবলো পিকাসোর তৈলচিত্র গুয়েরনিকায় রূপান্তরিত হয়েছে।
ইসরায়েলে এ তাণ্ডব চলাকালে অনেক জ্ঞানী-গুণীর পক্ষ থেকে একটি প্রশ্নই বারবার উত্থাপিত হতে থাকে—এ অপারেশনের প্রভাব ব্যাখ্যা করার সময় অনেকেই জানতে চান, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস কীভাবে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাবেন।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে কিছু বসতি স্থাপনকারী তাদেরই চারজন লোক মেরে ফেলার প্রতিশোধ হিসেবে ফিলিস্তিনের ছোট একটি শহর টারমাস আয়াতে একটি মারাত্মক হামলা চালায়। এ হামলায় একজন ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং অনেক বাড়িঘর, যানবাহন, শহরের অনেক স্থাপনাসহ বহু সম্পদ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ঘটনা ইসরায়েলি সেনাদের সামনেই ঘটে। কিন্তু তারা এসব ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য একটি আঙুলও তোলেনি। তারা নীরব ছিল। তবে এরকম ঘটনা এবারই প্রথম নয়, সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের আগেও আক্রমণ করেছে। এর পেছনে ইন্ধন দিয়েছিলেন ইতমার বেন গভির, ইসরায়েলের নেতানিয়াহুর একজন ডানপন্থি বর্ণবাদী মন্ত্রী।
কিন্তু সাম্প্রতিক এ ঘটনায় মাহমুদ আব্বাস, ২০০৫ সাল থেকে যিনি ফিলিস্তিনিদের দায়িত্বে আছেন, তার বলার আসলে কিছুই ছিল না। এ বছরের শুরু থেকে, নানারকম আক্রমণে ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। আর নিহতের বেশিরভাগই তরুণ ও যুবক। আর এসব ঘটনা তখনই ঘটেছে, যখন ইসরায়েলের সবচেয়ে ডানপন্থি সরকার একের পর এক বসতি সম্প্রসারণ চুক্তি উন্মোচন করেছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তার জনগণকে রক্ষা করার জন্য কিছুই না করায়, ফিলিস্তিনি যুবকরা সশস্ত্র প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে। ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে দশটি অভিযান চালানো হয়েছিল। জেনিন ক্যাম্প এবং নাবলুস প্রতিরোধের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল এবং বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি তাদের পেছনে ছিল। ফাতাহ প্রতিনিধিত্বকারী পুরোনো দলগুলো তাদের প্রভাব হারাচ্ছিল। তাই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল অথরিটি বা পিএর ওপর আস্থা হারিয়েছিল। আর এর ফলে, তারা একটি বিকল্প খুঁজতে শুরু করে।
এরপর একটি রহস্যময় নীরবতা। তারপর আব্বাস সোমবার রাতে সব দলকে মিলিত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি একটি ঘোষণাও দিয়েছিলেন, যদিও সেটা প্রথমবার নয়। ঘোষণাটি হলো—পিএ নিরাপত্তা সমন্বয়সহ ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করছে। তবে খুব কম লোকই বিশ্বাস করেন, তিনি তার এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করবেন।
প্রায় ৩০ বছর বয়সী পিএর জীবনে এটি একটি বিভক্তিকর সময় হিসেবে দেখা দেয়। অসলো চুক্তির একটি আবিষ্কার, যা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের হাতে স্বাধীনতা হস্তান্তর করার আগে পাঁচ বছরেরও কম সময় ধরে বিদ্যমান থাকার কথা ছিল। এখন ৮৭ বছর বয়সী মাহমুদ আব্বাস এবং পিএ, দুজনই বার্ধক্যের বোঝা অনুভব করছেন।
মাহমুদ আব্বাস চলে গেলে পিএর উত্তরাধিকার বেশ কয়েকটি পক্ষের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ আব্বাস চলে গেলে পিএর ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে সবাই বেশ চিন্তিত। দেরিতে হলেও সম্প্রতি ইসরায়েলিরা নিজেদের মধ্যে এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করছে। জর্ডান, মিশর, কাতার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবই বিভিন্ন কারণে চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে চিন্তিত।
আব্বাস মূলত একবার পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি কখনো উত্তরসূরি বা কোনো নির্বাচন করেননি। আবার তিনি কখনো ক্যারিশম্যাটিক নেতাও ছিলেন না। ইয়াসির আরাফাত যখন যুদ্ধময়দানে, তিনি তখন একজন সরকারি আমলার দায়িত্ব পালন করছিলেন। ফিলিস্তিনের বিপ্লবী আরাফাতের তুলনায় আব্বাস কিছুটা কম উচ্চাভিলাষী এবং কম দৃঢ়। তাও এটা মনে রাখতে হবে যে, কোনো নেতার ভাগ্য খারাপ তখনই হয়, যখন তিনি তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন।
এমনকি যদি আব্বাস এগিয়ে যান এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সব সমন্বয় শেষ করার হুমকি পালনও করেন, তবুও তা পিএকে বাঁচাতে তেমন কিছু করবে না। এখানে অন্তত দুটি বাস্তবতা রয়েছে, যা তার বিরুদ্ধে কাজ করবে—একটি চরমপন্থি ইসরায়েলি সরকার যেটি সশস্ত্র ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ চূর্ণ করার জন্য নিয়োজিত, যখন পশ্চিম তীরের অবশিষ্ট ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনাকে ত্বরান্বিত করছে এবং একটি ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ যা ক্রমেই সশস্ত্র সমর্থনকারী হয়ে উঠছে নানারকম সংগ্রামের মাধ্যমে।
অতীত কখনো পরিবর্তন করা হয় না বা যায় না। কিন্তু আগামী বা ভবিষ্যতের ব্যাপারটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। হামাস পিএর প্রতিদ্বন্দ্বী, পশ্চিম তীরে তার জাল বিস্তার করেছে এবং এমনকি যদি অল্পবয়সী ফিলিস্তিনিরা দলে দলে যোগদান না করে, তবুও তারা দখলদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠিত হয়ে আছে।
ফিলিস্তিনে পিএকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল একটি দল হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে। তাই আব্বাস-পরবর্তী সময়ে এই দলটির টিকে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ কারণেই উত্তরাধিকার ইস্যুটি একই সঙ্গে এত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপ্রাসঙ্গিক। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান ও মিশরসহ, একটি মসৃণ উত্তরণ দেখতে চায়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এ উত্তরণ দেখার জন্য কারও কাছেই প্রয়োজনীয় রসদ নেই। এসব ঘটনায় বেশ কিছু নাম ঘুরপাক খাচ্ছে। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নির্বাহী কমিটির সম্পাদক—জেনারেল হুসেইন আল-শেখের নাম রয়েছে; রয়েছে মাজেদ ফারাজ, পিএর গোয়েন্দা প্রধানের নাম। এ ছাড়া আছে নাসের আল-কুদওয়া, একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আরাফাতের একজন ভাতিজা, যিনি মারওয়ান বারঘৌতির সঙ্গে জোটবদ্ধ ফাতাহ স্প্লিন্টার গ্রুপের নেতা হিসেবে বাতিল হওয়া ২০২১ সালের আইন সভা নির্বাচনে আব্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রতিযোগী রয়েছেন তালিকায়—যেমন জিব্রিল রাজৌব, মোহাম্মদ দাহলান, সালাম ফাইয়াদ ও বারঘৌতি নিজেই।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতিটি প্রতিযোগীরই কিছু না কিছু সমস্যা আছে এবং সংশ্লিষ্ট সবার পক্ষে কোনো বিষয় নিয়ে একমত হওয়া বলতে গেলে এককথায় অসম্ভব। কিন্তু ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যরা যখন এ ধরনের নামগুলো পরীক্ষা করে, তারা এ সত্যটি উপেক্ষা করে যে, ফিলিস্তিনিদের একটি নতুন প্রজন্মের উত্থান ঘটছে এবং তাদের নিজস্ব কিছু এজেন্ডা ও পরিকল্পনা রয়েছে। জেনিন অপারেশনে যারা এখনো পর্যন্ত নিহত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগের বয়সই ২০-এর নিচে। তারা ফিলিস্তিনিদের একটি প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে যাদের পিএ, তার নেতা বা আব্বাসের উত্তরাধিকারী হতে পারে—এমন অন্য কোনো প্রতিযোগীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
ইসরায়েলেরও একটি বড় সমস্যা রয়েছে। নেতানিয়াহু, যিনি দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের কোনো ভক্ত নন, সম্প্রতি ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষাকে চূর্ণ করার সময় পিএকে সমর্থন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। বেশিরভাগ পশ্চিম তীরের লোকদের জন্য পিএ একটি পুরোনো সংস্থা। ইসরায়েল একটি ডুমুর পাতার প্রতিনিধিত্ব করে আর এ পাতার পেছনে ফিলিস্তিনি জমিগুলোর অবিচ্ছিন্ন সংযুক্তি লুকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু ইসরায়েলের ঔপনিবেশিক প্রকল্পের সঙ্গে এটা এখন স্পষ্ট যে, ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে রাখার উপযোগী লক্ষ্যপূরণে পিএর, যা নেতানিয়াহু চাইছেন, আসলেই সন্দেহজনক।
তাই প্রায় ৩০ বছর ধরে পিএ ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে যে, তারা অবৈধভাবে দখল করা জমিতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আর ইসরায়েলের এ প্রজেক্টে সাহায্য করেছে মার্কিন যোগসাজশ। তাই আশা করা যায়, মাহমুদ আব্বাস দৃশ্যপট থেকে চলে গেলে সবকিছুই বদলে যাবে।
লেখক : আম্মান বংশোদ্ভূত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন আমরিন খান
মন্তব্য করুন