প্রয়াত আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন জয়লাভ করে তখন একা জয়লাভ করে, আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় তখন সমগ্র জাতি পরাজিত হয়।’ আহমদ ছফার পুরো কথার সঙ্গে একমত না হলেও শেষোক্ত লাইনের সঙ্গে পুরোপুরি একমত। কেননা ক্ষমতায় এলে দেশের দল-মত নির্বিশেষে আপামর মানুষের প্রাপ্তিযোগ ঘটে। কিন্তু এ কথা সর্বাশেং সত্য যে, আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে সমগ্র জাতি পরাজিত হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রেসিডেন্ট মাসাতসুগু আসাকাওয়া টানা চতুর্থ মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় লেখেন—গত ১৫ বছরে আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি করেছে, অব্যাহত উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য একটি দৃঢ়ভিত্তি প্রদান করেছেন। মাসাতসুগু আসাকাওয়া বলেন, বাংলাদেশের বিশ্বস্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে এডিবি একটি গভীর অংশীদারত্বের মাধ্যমে আপনার সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন করতে প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির যাত্রায় সহায়তা করতে এডিবি আপনার সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ। অনেক ঝুঁকি মোকাবিলা করে ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করা গেছে। নির্বাচনবিরোধী তথাকথিত রাজনৈতিক জোট নির্বাচন বানচাল করার সব প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বলা হয়েছিল নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণা করতে পারবে না, যখন তপশিল ঘোষণা করা হয়েছিল—বলা হয়েছিল নির্বাচন করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তপশিল ঘোষণা হয়েছে এবং যথা সময়ে নির্বাচনও হয়েছে। প্রতিদিনই এক বা একাধিক দেশ নিয়মিতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বলা হয়েছিল, বিশ্বসভা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বীকৃতি জানাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নতুন সরকারের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ—এক. রাজনৈতিক, দুই. কূটনৈতিক, তিন. অর্থনৈতিক। তিন সপ্তাহের এই সরকারের কর্মকাণ্ড দেশবাসী লক্ষ্য করছে এবং ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনাও অবগত হচ্ছে। দেশীয় ও বিশ্ব বাস্তবতায় অর্থনৈতিক সংকটও দৃশ্যমান আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রায় সব আলোচনায়ই উঠে আসে— মূল্যস্ফীতি, হুন্ডি, মানি লন্ডারিং, ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া আর আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে বিষয়গুলো বাস্তবে কঠিন হলেও অনেকের প্রাত্যহিক আড্ডার বিষয় হয়ে উঠেছে। যাপিত জীবনে আপামর মানুষের মধ্যেও এসবের চর্চা দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতার্থে প্রতিটি বিষয় আমাদের নিত্যকার জীবনে এতটাই জড়িয়ে আছে যে, আলোচনাগুলো খুবই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের মুখে শোনা যায়, আমাদের প্রধান সমস্যা হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। অনেকটা গৎবাঁধা সমাধান এখন সর্বত্রই শোনা যায়—হুন্ডি কমাও, রেমিট্যান্স আনো, রপ্তানি বাড়াও, আমদানি কমাও ইত্যাদি। তবে এসব সমাধান বাতলানোর সময় এ ক্ষেত্রে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন কিংবা অপরাপর প্রতিযোগী দেশ কী করেছে, তা আমরা বিবেচনাতেই আনছি কি না?
বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই হুন্ডি চলছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র রূপ নিয়েছে। এ কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম অভিবাসন রেকর্ড পরিমাণে বাড়লেও রেমিট্যান্স যা এসেছে, তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশ কম। অভিযোগ আছে, প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডিতে বেশি রেট পেয়ে অফিসিয়াল চ্যানেলে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠান না। আর এ হুন্ডির কারবার যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তারা দেশ থেকে টাকা পাচারের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ হুন্ডি না কমার প্রধান কারণ টাকা পাচার বন্ধ না হওয়া। অনেকেরই প্রশ্ন, সরকার কি আজ অবধি হুন্ডি বন্ধে কোনো চেষ্টা করেছে? নাকি অনেকটা জোর করে ডলারের দাম কমিয়ে রেখে প্রকারান্তরে হুন্ডিকেই সাহায্য করা হচ্ছে? আইনগতভাবে অর্থাৎ বৈধভাবে দেশে পাঠানোর জন্য সরকার কভিডকালীন প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, তার পরও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে অর্থ পাঠানোর নিত্যনতুন পথ তৈরি করে ফেলছে। এ ছাড়া সরকারবিরোধী অংশ তথা দেশিবিরোধী অংশ একের পর এক নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, যারা টাকা পাচার করছে, তাদের ধরা কি খুব কঠিন? দুবাই-কুয়ালালামপুরে যারা বিনিয়োগ করেন; কানাডা, যুক্তরাজ্যে যাদের বাড়ি আছে, তাদের কথা পত্রিকায় প্রায় প্রকাশিত হয়। তাহলে সরকার তাদের ধরতে পারছে না—এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যতটা আমরা সহজভাবে বলতে শুনছি কাজটা ততটা সহজ কি? সহজ নয়; কিন্তু কাজটা এ সরকারকেই করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্বব্যাপী অবৈধ অর্থের লেনদেন নজরদারি সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি তাদের ২০০৬-২০২০ সাল পর্যন্ত হিসাবে দেখিয়েছে, ওই সময় বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর পাচার হয় প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা।
দুই. মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালের ১৮-২০ জানুয়ারি পর্যন্ত। সম্মেলনটি ১১২, সার্কিট হাউস রোডে তৎকালীন আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে এক দীর্ঘ বক্তব্য দেন।
আওয়ামী লীগের দশম সম্মেলন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দলের সভাপতি হন এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক হন জিল্লুর রহমান। এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন।
১৯৭৪ সালের সম্মেলনই ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেষ ভাষণ। আমি মনে করি, আজকের দিনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওই ভাষণটি পুরোপুরি মুখস্থ করা উচিত। এ ভাষণটি আমাদের জীবনে খুবই প্রাসঙ্গিক। ‘সেদিন ছাত্ররা আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলেছিলাম, আত্মসমালোচনা করো। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজকে চিনতে পারবা না। তারপর আত্মসংযম করো, আর আত্মশুদ্ধি করো। তাহলেই দেশের জন্য মঙ্গল করতে পারবা। ...। আওয়ামী লীগ কর্মী-ভাইয়েরা, কোনোদিন তোমরা আমার কথা ফেল নাই। জীবনে আমি কোনোদিন কনটেস্ট করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বা প্রেসিডেন্ট হই নাই। জীবনভর তোমরা আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছ। তোমরা আমার কথায় রক্ত দিয়েছ, আজ শেষ দিনে—কেননা সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি, তোমরা আমার কথা মনে রেখ। আমার কথা ভুলো না। কোনোদিন স্বার্থে অন্ধ হয়ে তোমাদের ডাক দেই নাই। কোনোদিন কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে কোনো শয়তানের কাছে মাথা নত করি নাই। কোনোদিন ফাঁসির কাস্টে বসেও বাংলার মানুষের সাথে বেইমানি করি নাই। আমি বিশ্বাস করি তোমরা আমার কথা শুনবা, তোমরা আত্মসমালোচনা করো, আত্মসংযম করো। তোমরা আত্মশুদ্ধি করো। দুই চারটা পাঁচটা লোক অন্যায় করে, যার জন্য এত বড় প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, যে প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা এনেছে, যে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ কর্মী জীবন দিয়েছেন, যে প্রতিষ্ঠান ২৫ বছর পর্যন্ত ঐতিহাসিক সংগ্রাম করেছে, তার বদনাম হতে দেয়া চলে না। ...আজ বাংলার নিভৃত কোণে আমার এক কর্মী পড়ে আছে, যার জামা নাই, কাপড় নাই। তারা আমার কাছে আসে না। আপনাদের অনেকেই এখানে। কিন্তু আমি যদি চর কুকরিমুকরি যাই, আমার ওই ধরনের কর্মীকে আসতে দেখি। এদের সাথে আমার রক্তের সম্বন্ধ। আজও আমি দেখি তার পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি। আজও দেখি, সেই ছেঁড়া পায়জামা, ছেঁড়া শার্ট, পায়ে জুতা নাই। বাংলাদেশে আমার এ ধরনের লক্ষ লক্ষ কর্মী আছে। কিন্তু কিছু কিছু লোক যখন মধু-মক্ষিকার গন্ধ পায়, তখন তারা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমায়। আওয়ামী লীগের নামে লুটতরাজ করে। পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগ কর্মীরা, আওয়ামী লীগ থেকে তাদের উৎখাত করে দিতে হবে—আওয়ামী লীগে থাকার তাদের অধিকার নাই।’
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সততা ও দেশপ্রেম খুব জরুরি। আরও দরকার দলীয় সংহতি। গত নির্বাচনে যে বিভাজনের রেখা ফুটে উঠেছে, তা দ্রুত সংহতির জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন আওয়ামী লীগের অনেক কাজ; সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। একটা ছোট উদাহরণ এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ট্র্যাজেডির নাম ছিল ‘বাসন্তী’। কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় এক জেলে পরিবারের বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে বাসন্তীর জাল পরে লজ্জা নিবারণের ছবি প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। আর সেই বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত ছবির ফটোগ্রাফার ছিলেন ইত্তেফাকেরই নিজস্ব আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদ। এই ছবি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সরকারকে রাজনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছিল। দেশের আনাচে-কানাচে দুর্ভিক্ষের আগমনি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। সেসময় তিনজন লোক গিয়েছিল বাসন্তীদের বাড়িতে। তাদের মধ্যে একজন ছিল তৎকালীন স্থানীয় রিলিফ চেয়ারম্যান; তার নাম আনছার আলি পাঠান। এই আনসার আলি পাঠান ছিল নব্য আওয়ামী লীগার, মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল আওয়ামীবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী দলের সদস্য। তৎকালীন ওই নব্য আওয়ামী লীগাররাই তখন বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক