মোস্তফা কামাল
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৩৩ এএম
আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইউনূসে বিএনপির ব্যাকপেইনে মালিশ

ইউনূসে বিএনপির ব্যাকপেইনে মালিশ

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে কচলানি কি বেশির চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে না? ঘটনার ফের আবার চক্কর দিচ্ছে তাকে ঘিরে। শেষ হয়েও না হওয়ার মতো অবস্থা। শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দেওয়া সাজা ও দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলে স্থায়ী জামিন পেতে না পেতেই অর্থ আত্মসাৎ মামলায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের চার্জশিট কি খুব জরুরি ছিল? এখন বলা হচ্ছে, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে দেশের বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতে, এটি পরিকল্পিত চক্রান্ত। ড. ইউনূসের মামলা দ্রুত শেষ হলেও তাতে আইনের ব্যত্যয় হয়নি দাবি তার। নোবেলজয়ীসহ বিশ্বের বিশিষ্ট নাগরিক ও ১২ জন সিনেটরের বিচারিক কার্যক্রম দেখার বিষয়টি বিবেচনার ইঙ্গিতও দেন তিনি।

গোটা বিষয়টি হাতে ধরে জটিলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার গতিময়তা স্পষ্ট। ড. ইউনূসকে কখনো উদ্দেশ্য, কখনো বিশেষ করার ব্যাপারে সরকার পিছু হটছে না। হাল ছাড়ছেন না ইউনূসও। তার বিরুদ্ধে হেন কথা নেই যা না বলা হচ্ছে সরকারের দিক থেকে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবীই দুদকের আইনজীবী। নিজেকে সরকারপক্ষের নন দাবি করে তিনি বলেছেন, এ মামলায় সরকারের কোনো হাত নেই। আর ড. ইউনূসের প্রশ্ন—কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর কি সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়? প্রশ্নের সঙ্গে এও জানিয়েছেন, সরকারের এসব তৎপরতায় বিচলিত নন তিনি। কী দাঁড়াচ্ছে মানেটা? একদিকে তাকে নিয়ে অবিরাম কচলানি। অতি কচলানিতে লেবুকে তিতা করে ফেলার জোগাড়। ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক কথাবার্তা ও মতিগতিতে তার নিজেরও তিতার খাতায় অভ্যস্ততার মানসিকতা লক্ষণীয়।

এবারের নতুন বছরটি শুরু হয়েছে শ্রম আদালতে ড. ইউনূসের সাজা ঘোষণা দিয়ে। পরে জামিনের মধ্য দিয়ে সেটার একটি মধ্যমমানের হিল্লা হয়েছে। বছরের দ্বিতীয় মাস ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন দেওয়া হলো অর্থ আত্মসাৎ মামলার চার্জশিট। একইদিন মামলা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দিতে প্রেস ব্রিফ করেছেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা কারও অঙ্গুলি হেলনে চলি না। দেশে আইন আছে, আমরা সেই আইনে দেশ চালাব।’ এ কথাও বলেছেন, ড. ইউনূসকে হয়রানির উদ্দেশ্য কিছু করছে না সরকার। সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা মামলা দিয়েও হয়রানি করছে না। শ্রম আইনের মামলাটি করেছে শ্রমিকরা। পরে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিদপ্তর তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

খেয়াল করলেই উপরোক্ত শব্দ-বাক্যের তরজমা পরিষ্কার। সরকার ড. ইউনূসের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত-অসিহষ্ণু, তা বুঝতে বড় মাপের বুঝদার হওয়া লাগে না। তার বিদেশি বন্ধুজনরাও এতে ওয়াকিবহাল। তার মামলা পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর প্রস্তাব এসেছে সেই বুঝ মতোই। শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার রায় এবং দুদকের মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ২৪২ ব্যক্তি। চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনও রয়েছেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে নোবেলজয়ী রয়েছেন ১২৫ জন। আছেন তাওয়াক্কুল কারমান, নাদিয়া মুরাদ, মারিয়া রেসা ও হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসসহ ১৬ জন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রয়েছেন ৬ জন। তাদের মধ্যে ওরহান পামুক ও জে এম কোয়েটজি রয়েছেন। জোসেফ স্টিগলিৎজসহ অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী আছেন ১২ জন। রসায়নে ৩৬ জন নোবেল বিজয়ী, চিকিৎসাশাস্ত্রে ২৯ জন নোবেল বিজয়ী এবং পদার্থবিজ্ঞানে ২৬ জন নোবেল বিজয়ী রয়েছেন। এর আগে ড. ইউনূসের সঙ্গে আচরণ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে গত বছর প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন ৪০ বিশ্বনেতা। এর জবাবে সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূসের মামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘যার বিরুদ্ধে মামলা, তার সব দলিল-দস্তাবেজ তারা খতিয়ে দেখুক। সেখানে কোনো অন্যায় আছে কি না, তারা নিজেরাই দেখুক।’ এবারের চিঠিতে সেই প্রস্তাব বা অভিপ্রায় লুফে নেওয়া হয়েছে। তারা একজন সিনিয়র আন্তর্জাতিক আইনজীবীর নেতৃত্বে স্বাধীন আইন বিশেষজ্ঞদের একটি দল পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। বলেছেন, কাজটা তারা দ্রুতই সারতে চান। চিঠিতে মনে করিয়ে দেওয়া হয়—শান্তিতে নোবেল পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম ও কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পাওয়া বিশ্বের মাত্র সাতজন ব্যক্তির একজন হচ্ছেন ড. ইউনূস।

এর বিপরীতে মার্কিন হাতের সরাসরি ছোঁয়া দেখছে সরকার। আর এটাই বাস্তব ও যৌক্তিক। আরও ইঙ্গিতপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, চিঠিতে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কথাও রয়েছে, যা অবশ্যই সরকারকে আহত না করে পারে না। চিঠিটিতে বলা হয়েছে, ‘বিরোধীদলীয় নেতাদের দমন ও কারাগারে প্রেরণ এবং মিডিয়া ও স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে দমন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে অনেক মানবাধিকারকর্মী এবং গণতন্ত্রপন্থি গ্রুপ এ বিষয়গুলো নথিবদ্ধ করেছে। এর আগে ড. ইউনূসের প্রতি হয়রানি বন্ধে ১৯০ জন বিশ্বনেতার আরেকটি চিঠির প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী গত বছর আগস্টের শেষদিকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ পাঠান, আইনজীবীরা এসে দেখে যাক এখানে কোনো অবিচার হয়েছে কি না অথবা মামলাটি অন্যায়ভাবে করা হয়েছিলে কি না।’ প্রধানমন্ত্রীর সেই ‘আমন্ত্রণ’ই গ্রহণ করা হলো বলে ওই খোলা চিঠিতে জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘এই পর্যবেক্ষণ শুধু গত পহেলা জানুয়ারি শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় দেওয়া রায়েই নয়, বরং দুর্নীতি দমন কমিশন পরিচালিত চলমান তদন্তও করা হবে।’

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ঢাকার শ্রম আদালতে শ্রমিকদের করা আরও ১৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। নমুনায় স্পষ্ট ইউনূসের ঘটনার ঘনঘটা আরও বিস্তৃত হচ্ছে নানা উইংয়ে। আগেও বিভিন্ন দেশে এ ধরনের মামলা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হওয়ার নজির আছে। ইউনূস প্রশ্নে সরকার যে অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে পিছু হটা বা চুপ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের চাপ উপেক্ষা করে সরকার ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আর কতদূর অগ্রসর হতে পারে তাও দেখার বিষয়। প্রতিপক্ষের মিছিল, মিটিং, হরতাল, অবরোধ, প্রতিরোধ, বয়কট, অসহযোগ ইত্যাদি উতরে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সংসদ নির্বাচন সাঙ্গ করে যখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, তখন গলায় কাঁটার মতো বিঁধে ফেলেছে ড. ইউনূসকে। সরকার বনাম বিরোধী দল না হয়ে ব্যাপারটা গড়িয়েছে সরকার বনাম ইউনূসে। সরকারের জাত শত্রু বিএনপির জন্য তা কিছুটা স্বস্তির মতো। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির শুধুই খরার টান। পুলিশ সদস্য হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুরসহ নাশকতার মামলায় ধরপাকড়ের শিকার বিপুল নেতাকর্মী। এখনো কারান্তরীণ সিনিয়রসহ নেতাকর্মীদের অনেকে। এতে বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অকুলান হয়ে পড়ছে। মূল দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছে আন্দোলনের ব্যর্থতা নিয়ে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৮ অক্টোবরের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি জামিন পাননি। বিএনপির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মির্জা আব্বাসও কারান্তরীণ। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির প্রায় ২৩ হাজার নেতাকর্মী কারাবন্দি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এমন কোনো নেতা নেই যার বিরুদ্ধে মামলা নেই। আর সারা দেশে ১ লাখ ১১ হাজার মামলায় দলের প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপির এ পরিসংখ্যান মানতে নারাজ সরকার। সরকারি তরফে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি মনে করা হচ্ছে না।

একদিকে নেতারা কারাবন্দি, ফেরারি; অন্যদিকে দলের মধ্যে চলমান দোষারোপ ও যন্ত্রণার মধ্যে ড. ইউনূস ইস্যু দলটিকে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। ভোটের পর নতুন প্রেক্ষাপটে আন্দোলন-কর্মসূচির ধরন ও কৌশল ঠিক করা নিয়েও কাহিল নেতাকর্মীরা। এক পা এগোলে তিন পা পেছনে পড়ে যাওয়ার এ সময়ে ইউনূস ইস্যু বিএনপির ব্যাকপেইনে কিছুটা হলেও মালিশ জোগাচ্ছে। ইউনূস ইস্যুতে বসে বসে মজা দেখার একটি মওকা এসেছে দলটির জন্য। বাংলাদেশের বার কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী, যারা সংগঠনটির সদস্য তারাই শুধু আদালতে মামলার শুনানি করতে পারে। আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাদের মামলা দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। এ অবস্থায় সরকার আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের এই রিভিউতে সরকার অংশ নিতে দেয় কি না, দিলে কী হবে, না দিলে কী হবে—তা বায়োস্কোপের মতো দেখার সুযোগ পেল বিএনপি।

লেখক: ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাইসির খোঁজে ৩২ সদস্যের দল পাঠাচ্ছে তুরস্ক

ইরানের প্রেসিডেন্টের দুর্ঘটনাস্থল থেকে মিলল সংকেত

কেন এত সময় লাগছে অনুসন্ধানে

টানা চারটি লিগ জয়ীদের এলিট ক্লাবে ম্যানসিটি

হেলিকপ্টার পাওয়ার বিষয়ে যা জানাল রেড ক্রিসেন্ট

রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে আর যারা ছিলেন

উন্নয়নের নামে রাতের আঁধারে শাহবাগে গাছ কাটার অভিযোগ

সবশেষ বিহারে ছিলেন এমপি আনার

‘অভিবাসী কর্মীদের জন্য আরও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজ করছে সরকার’

ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিখোঁজ, যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

১০

স্বামীর মোটরসাইকেলের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে নারীর মৃত্যু

১১

তবুও প্রার্থী হলেন সেই নাছিমা মুকাই 

১২

গাজীপুরে কারখানার ১০ তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে নারী শ্রমিকের মৃত্যু

১৩

রাজশাহীতে আগুনে পুড়ে ছাই ১০ বিঘার পানের বরজ

১৪

বিয়েবাড়ি থেকে কনের পিতাকে তুলে নিয়ে টাকা দাবি

১৫

ঠাকুরগাঁওয়ে নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর , এলাকায় উত্তেজনা

১৬

ঈশ্বরদীতে ফেনসিডিলসহ রেল নিরাপত্তা বাহিনীর সিপাহি আটক

১৭

এমপি আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ওসিকে নির্দেশ

১৮

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ১১৬ কোটিপতি প্রার্থী : টিআইবি

১৯

রাইসির জন্য দোয়ার আহ্বান

২০
X