একদিকে বিএনপি-জামায়াতসহ ৩০-৪০টি নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ডান-বাম রাজনৈতিক জোটের শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের এক দফা দাবিতে বছরাধিকাল লাগাতার আন্দোলন চালায় এবং হঠাৎই এ আন্দোলন ২০২৩-এর ২৮ অক্টোবর পথভ্রষ্ট হয়। তারা অগ্নিসন্ত্রাস, ভাঙচুর, হরতাল, অবরোধের দিকে ঠেলে দেয় দেশকে। এই পরিস্থিতিতে শুরু হয় জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ও শ্রমনীতি প্রয়োগের ভয়, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে অভিযোগের চাপ মোকাবিলা করে শেখ হাসিনার সাহসী ও কৌশলী নেতৃত্বের কারণে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। এবারের নির্বাচনে দলীয় নেতাদের অংশগ্রহণ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, নেতাদের জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে আত্মোপলব্ধি ও আত্মসমালোচনা করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। যারা বছরের পর বছর নেতৃত্বের আসনে থেকে এমপি হয়ে বা এমপি না হয়েও জনগণের মাথার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন, তাদের যেমন শিক্ষা হয়েছে, তেমনি যারা নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তারাও ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা চিন্তা করে সতর্ক থাকবেন বলে আশা করা যায়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও তৃণমূলে নেতাদের অবস্থানের প্রকৃত চিত্র জানার সুযোগ হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ববর্তী সংসদের তিনজন মন্ত্রীসহ ৭১ জন এমপিকে মনোনয়ন দেয়নি। মনোনয়নবঞ্চিতদের মধ্যে অন্তত ২৫ জন এমপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন যাদের অনেকেই পরাজিত হয়েছেন। এমনকি মনোনয়ন পাওয়া তিন প্রতিমন্ত্রীসহ ১৯ জন এমপিও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনবিচ্ছিন্নতার কারণে অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীকেও তুলনামূলক কম পরিচিত প্রার্থীর কাছে পরাজয় বরণ করতে হয়।
১১ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৩৭ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করে। নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত এবারের মন্ত্রিসভার অন্যতম চমক হচ্ছে ডা. সামন্ত লাল সেনের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাওয়া। কর্মোদ্যোগী, সৎ ব্যক্তিত্ব ডা. সেন দায়িত্ব গ্রহণ করে স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করা ও স্বাস্থ্যসেবাকে তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, স্বাস্থ্য খাতের বিরাজমান অব্যবস্থাপনা দূর করে তিনি তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবেন।
নির্বাচনী ফল ঘোষণার পরদিনই চীন, রাশিয়া, ভারতসহ সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে তাকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অনাবাসী ১৪ জন রাষ্ট্রদূতও শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারের তাদের ভাষায় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ না হওয়া নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের এবং অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারত্ব জোরদারে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যকার বন্ধুত্বের গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অধিকার ও স্বাধীনতার অগ্রগতির পাশাপাশি রাজনৈতিক জীবনে সমঝোতার পরিবেশে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার আশা করেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ অঞ্চলে আমেরিকার ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার তাগিদে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবিক সহায়তাসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করে শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলিও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। জাতিসংঘ নির্বাচন এবং মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদার করার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এর আগে ২০২৩ সালের মার্চে ১৭৫ জন বিশ্বনেতার ড. ইউনূসকে ‘বিচারিক হেনস্তা’র শিকারে পরিণত করার অভিযোগ তুলে শেখ হাসিনাকে দেওয়া চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী পাঠানোর যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের শ্রম আদালতে সাজার পর ২৪২ জন আন্তর্জাতিক বিশিষ্ট নাগরিকের তার এ শাস্তিকে তাদের বিবেচনায় ‘প্রতারণামূলক বিচার’ মনে করে ২৮ জুনের পত্রে আইনজীবী প্রেরণে শেখ হাসিনার ‘আমন্ত্রণ’ গ্রহণ করে। সরকারের উচিত হবে আন্তর্জাতিক আইনজীবীর উপস্থিতিতে বিচারকার্য সম্পাদন করে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সুরাহা করা। অন্যথায় ড. ইউনূস ইস্যুটি সরকারের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে থাকবে। অবশ্য এরই মধ্যে ইউনূসকন্যা মনিকা ইউনূসের সিএনএনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সরকারকে সমঝোতা প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে পরোক্ষে তার পিতার অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন বলে অনুমিত হয়। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে সরকার ও আন্দোলনকারী দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন-পূর্ব কয়েক মাস বিরামহীন যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু তিনি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর তিনি নিজ দেশের স্বার্থরক্ষায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। দৈনিক কালবেলায় দিন কয়েক আগে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান মার্কিন দূতাবাসে পিটার হাসের সঙ্গে দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করে তাদের পুরোনো অভিযোগগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। মার্কিন দূতাবাসও মঈন খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করেছে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে।
আওয়ামী লীগ এবারও নির্বাচনের প্রাক্কালে ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা দিয়েছে। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে কৃষি, বিদ্যুৎ, ভৌত অবকাঠামোসহ অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নয়ন হলেও কোনো কোনো এমপি বা নেতার অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক উল্লম্ফন, ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বা আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বিদেশে পাচার করা, সড়কে যানবাহনে চাঁদাবাজি, যা বন্ধ করার জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয়, চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে রাস্তায় ফুটপাতে হকার বসিয়ে একশ্রেণির নেতার বিনা পুঁজিতে চাঁদাবাজির দোকান খুলে বসা, ছাত্র ও যুব সংগঠনের এক অংশের চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানাবিধ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া, ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের একশ্রেণির কর্মচারীর অনৈতিক সুবিধা আদায়ে সময়মতো কাজ না করে জনগণকে হয়রানি করা, অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতির কারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করতে বাধ্য হওয়া, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অব্যাহত নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হলেও যথাযথ বিচার না পাওয়া, সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি কথিত সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়ত্ব, মাথাপিছু আয় বাড়লেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিস্তৃতি, দুর্নীতির সূচকে দুই ধাপ নিচে নেমে যাওয়া জনগণকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে। সব স্তরে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে যেমন কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না, তেমনি প্রকৃত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাও দুরূহ হবে। নির্বাচনই গণতন্ত্রের একমাত্র মানদণ্ড নয়। সুশাসন থাকলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার তার সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনাআপনি জায়গা করে নেবে। সরকারের এবারের মেয়াদ আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন সময়। এ মেয়াদে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আগামী নির্বাচনে যদি সব দল অংশগ্রহণ করে, তাহলে আওয়ামী লীগকে হয়তো কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হতে পারে।
লেখক: সমাজকর্মী