ড. মো. মফিদুল আলম খান
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৩ এএম
আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মৃত্তিকাঞ্জলি: একটি পর্যালোচনা

মৃত্তিকাঞ্জলি: একটি পর্যালোচনা

মা-মাটি-দেশ আমাদের মানসপটে চির অম্লান। সব সৃষ্টির আদিরূপ হলো মাটি। মাটিতেই সব কিছুর সৃষ্টি এবং বিনাশ। পৃথিবীর সব সম্পদ বুকে ধারণ করে মাটি চির শক্তির আধার। এই মাটিতে নলখাগড়ার আঁকাআঁকি, খেলাধুলা যত সহজ, তাকে শিল্পকর্মে রূপ দেওয়া ততই কঠিন। তবুও শিল্পকলার প্রাচীন মাধ্যম মাটি।

বিশ্বসভ্যতার প্রতিটি পরতের মতো ভারতবর্ষে শিল্পকলার প্রাচীন এবং অন্যতম শিল্পমাধ্যম হলো ‘মৃৎশিল্প’। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো ৩৩০০ থেকে ১৩০০ খ্রিষ্টপূর্ব (পূর্ণবর্ধিত কাল ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টপূর্ব), ময়নামতি বৌদ্ধবিহার খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের শেষ দিক থেকে অষ্টম শতকের প্রথম দিক, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষ দিক থেকে নবম শতকের প্রথম দিক (৭৮১-৮২১) পর্যন্ত মৃৎশিল্পের সরব অস্তিত্ব বিদ্যমান। মৃৎশিল্প প্রাচীন বাংলার আদি শিল্পধারা।

‘মৃৎশিল্প’ এর ইংরেজি হলো ‘Ceramic Art’। নমনীয় মাটিকে আকৃতি দান করে, উচ্চতাপে পুড়িয়ে, তারপর ঠান্ডা করে কঠিন রূপ দিয়ে ‘মৃৎশিল্প’ বা ‘সিরামিক আর্ট’ তৈরি করা হয়। সিরামিক আর্ট একটি কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়া। গুণগত মাটি সংগ্রহ, মাটি প্রস্তুত, আকৃতি গঠন, শুকানো, পোড়ানো, পর্যাপ্ত সময় ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত করে এগিয়ে যেতে হয়। সিরামিক আর্ট প্রধানত তিনটি ধারায় চলমান।

(ক) ঐতিহ্যবাহী ধারা।

(খ) কারখানায় নির্মিত ধারা।

(গ) স্টুডিওভিত্তিক ধারা।

শিল্পী অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলাম প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে এই স্টুডিওভিত্তিক ধারায় সিরামিক আর্ট চর্চা করে চলেছেন। যেখানে সিরামিক শিল্পের প্রকৃত সৃজনশীল ভাবধারা প্রস্ফুটিত।

২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার, জয়নুল গ্যালারিতে শিল্পী আজহারুল ইসলামের ‘মৃত্তিকাঞ্জলি’ শিরোনামে স্টুডিওভিত্তিক সিরামিক আর্ট প্রদর্শনী উদ্বোধন হয়েছে। এটি তার একক তৃতীয় সিরামিক আর্ট প্রদর্শনী। প্রদর্শনী ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার পর্যন্ত চলবে। এ ছাড়া শিল্পী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রায় ১১৯টি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন।

শিল্পকর্ম নির্মাণ নিখুঁত এক বুনন পক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় শিল্পী তার সব আকাঙ্ক্ষা, বোধ, ক্রোধ, শ্রম, প্রেম দিয়ে মননশীল, নান্দনিক সত্তায় জড়বস্তুতেও প্রাণের সঞ্চার করেন। ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো বার্তা শিল্পীর নিগূঢ় অন্তরের ভাষায় তার লালিত, বিশ্বাসের প্রতীক শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চান।

কিন্তু সৃষ্টির পর শিল্পেরও একটি ভাষা তৈরি হয়। তখন শিল্পকর্ম নিজেই তার পরিচয় বা বার্তা বহন এবং প্রকাশ করে। বিশেষ করে গবেষণাধর্মী শিল্পকর্মে শিল্পীর পুরো অভিব্যক্তি প্রকাশ নাও হতে পারে। সেখানে শিল্পকর্ম নিজেই নির্মোহ ভাষায় ভালো-মন্দ, পূর্ণ-অপূর্ণ, সুন্দর-অসুন্দর, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন পুরো বক্তব্য ব্যক্ত করে।

উপস্থাপিত শিল্পকর্মের বেশকিছু বৈশিষ্ট্য দর্শকের নজর কেড়েছে।

নীলা-হীরা-চুন্নি-পান্না এর রঙে মানব-মানবীর চিরায়ত নিগূঢ় যুগল ভালোবাসা। শত কোলাহল, ব্যস্ত জীবনেও হিম-নীরব স্তব্ধতায় নিমজ্জিত ব্যাকুলতা। থমকে দাঁড়াতেই হবে। চোখ ফেরানোর নিমেষ নেই। আনমনে বেজে ওঠে ‘জীবনানন্দ দাশ’ এর চেনা সুর লহরী—‘তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’

অসংখ্য দণ্ডায়মান হাত এবং মাথা প্রদর্শিত। হাতে মানুষের ভাগ্যরেখা অঙ্কিত আর মাথায় বুদ্ধি রক্ষিত থাকে। প্রত্যেক মানুষ বুদ্ধি খাটিয়ে দুহাতে কর্মসম্পাদনে সাফল্য অর্জন করেন।

বেশকিছু শায়িত হাত এবং মাথা উপস্থাপিত, যা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে। এগুলো সারিবদ্ধভাবে উপস্থাপনে পরিকল্পিত হত্যার নিদর্শন চিহ্নিত হয়েছে।

দেয়ালে স্থাপিত অগণিত অভালাকৃতির নক্ষত্ররাজি অভিরাম নীলাভ দ্যুতি ছড়িয়ে মুখরিত গ্যালারিকে মোহিত করেছে।

শত চাওয়া-পাওয়া, অভিযোগ-অনুযোগেও রাজা রাজ্য শাসনে অবিচল। যেখানে ন্যায়-অন্যায়ে সব নাগরিক শাসকের মুখোমুখি। পদভেদে উঁচু-নিচু আসন বিন্যাসে সভাসদদের পরামর্শ। সব সিদ্ধান্তে গুটিকয় সমর্থিত উঁচু হাত। তাদের ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী। থরে থরে সাজানো অনেক আলোকোজ্জ্বল বাটিকা। যেন জনগণ থেকে অনেক দূরে তবুও রাজমুকুট সুরক্ষিত।

ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন পুরুত্বের, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের শিল্পকর্ম হলেও প্রতিটিই ধূসর রঙের। নমনীয় মাটির আকৃতিকে বিভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রণে প্রয়োজনীয় তাপে পুড়িয়ে একই ধরনের রং নিশ্চিত করা সত্যি আশ্চর্যের, যা দীর্ঘ গবেষণা এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে শিল্পী সার্থকভাবে রপ্ত এবং প্রয়োগ করতে পেরেছেন। শিল্পী বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, তাপ, চাপ ব্যবহার করে চাকচিক্য এবং ঝলমলে শিল্পের মধ্যেও প্রকৃত পলি মাটির ধূসর রংকেই অতি মমতায় ধরে রেখেছেন।

শিল্পী আজহারুল অত্যন্ত সচেতনভাবে চিরায়ত যুগল ভালোবাসা, অসংখ্য দণ্ডায়মান হাত এবং মাথা, বেশকিছু শায়িত হাত এবং মাথা, অগণিত নক্ষত্ররাজি, অনেক আলোকোজ্জ্বল বাটিকা গুচ্ছভাবে কম্পোজিশন করেছেন। এতে শিল্পী মানুষের ঐক্য, শক্তির ঐক্য এবং বস্তুর ঐক্যকে সামষ্টিকভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবন, কর্মজীবন, সামাজিক জীবন এবং রাজনৈতিক জীবনে অমোঘ অমিয় হয়ে উঠতে পারে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক

ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা আজ

‘খালেদা জিয়া বাংলাদেশের মানুষের আপনজন’

২০ বছরের ব্যবসা বাঁচাতে ছাড়লেন চেয়ারম্যান পদ

তাসনিম অনন্যার অনুসন্ধানে মহাবিশ্বের চাঞ্চল্যকর রহস্য উন্মোচন

২০২৬ বিশ্বকাপে কবে মুখোমুখি হতে পারে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল?

বিশ্বকাপের গ্রুপ অব ডেথে ফ্রান্স

নুরুদ্দিন অপুর হাত ধরে আ.লীগ নেতার বিএনপিতে যোগদান

২০২৬ বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠিত: দেখে নিন কোন গ্রুপে কোন দল

২০২৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ যারা

রাতে আবার হাসপাতালে গেলেন জুবাইদা রহমান

১০

যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়ছে, তালিকায় ৩০টির বেশি দেশ

১১

খালেদা জিয়ার এন্ডোসকপি সম্পন্ন, বন্ধ হয়েছে রক্তক্ষরণ

১২

‘বাঁধের মাটি বড় বড় খণ্ড হয়ে ঝুপঝাপ শব্দে ভেঙে পড়ে’

১৩

রাজমিস্ত্রির বাড়ি থেকে অস্ত্র-গুলি উদ্ধার

১৪

দেড় হাজার দৌড়বিদের অংশগ্রহণে হাফ ম্যারাথন

১৫

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় ফ্রি যাত্রীসেবা

১৬

বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা, প্রতিবাদে বিক্ষোভ 

১৭

যুবদল নেতা সুমনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার

১৮

দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত ১০

১৯

গণতন্ত্র মঞ্চের নতুন সমন্বয়ক সাইফুল হক

২০
X