সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ২১ আশ্বিন ১৪৩২
ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৪, ০১:৫৯ এএম
আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন চান মালিকরা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন চান মালিকরা

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন সম্প্রতি আপিল বিভাগ কর্তৃক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরের কাছে পরামর্শ ও নির্দেশনা চেয়ে একটি আবেদন পাঠিয়েছেন; যা উপরিউক্ত শিরোনামে কালবেলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আবেদনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে—২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে প্রতিষ্ঠিত ও ট্রাস্ট আইনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্বৃত্ত আয়ের ওপর করারোপ একে অন্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সমূহ যাতনার উৎস হতে পারে। সেদিক থেকে তার বড় কথাটাই ছিল, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, সেহেতু এখানে কর ধার্য করা ঠিক নয়। প্রসঙ্গত, ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি বলেছেন, ‘যদি কর ধার্য করতেই হয় তাহলে বিদেশের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লাভজনক ও অলাভজনক শ্রেণিতে বিভক্ত করে আলাদা কিছু করা যেতে পারে।’

২০১০ সালের আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মালিক নেই, আছে প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠাতার সংজ্ঞায় বলা আছে—‘প্রতিষ্ঠাতা অর্থ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকারী কোনো জনকল্যাণমূলক ব্যক্তি, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট ও প্রতিষ্ঠান।’ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় ট্রাস্ট ছাড়াও অন্য বিকল্প রয়েছে, তবুও ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী সব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে দাতব্য ট্রাস্ট দ্বারা। অতএব আইন অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বৃত্তের ওপর কর গ্রহণ কিংবা প্রদান বেআইনি এবং ২০১০ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওই আইনে ৪৪(৪) ধারায় বলা আছে—‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতিত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাইবে না।’ স্পষ্ট প্রতিষ্ঠাতা যে বা যারাই হোক না, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বৃত্ত বা লভ্যাংশ ঘোষণা বা নেওয়ার অধিকার কারও নেই। এ আইনে সংরক্ষিত তহবিল এবং সাধারণ তহবিল রাখার বিধান আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেতন, ফি ও অন্যান্য উৎস হতে প্রাপ্ত একটি সাধারণ হিসাবে থাকবে, যা লভ্যাংশ হিসেবে প্রদান করা যাবে না।

শেখ কবির রাষ্ট্রপতি ছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী ও ইউজিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও চিঠি দিয়েছেন। তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে লিখেছেন—‘আপিল বিভাগের রায়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিকে থাকা কঠিন হবে, যাতে শিক্ষক-কর্মচারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ আর ইউজিসি চেয়ারম্যানকে লিখেছেন—‘ইউজিসি নিজেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে। সাম্প্রতিক রায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত এবং যার ফলাফল হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধের আশঙ্কা এবং অস্থির পরিস্থিতির জন্ম।’ সে দুটো চিঠির ভাষ্যে ভিন্নতা থাকলেও উৎকণ্ঠার বিষয়টা অভিন্ন।

কালবেলার রিপোর্ট বা শেখ কবির সাহেবের প্রদত্ত তিনটি চিঠির কোনোটির কোনো প্রতিক্রিয়া আমাদের নজরে আসেনি। তবে এরই মধ্যে জানা গেছে, এ বকেয়া কর সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ সুদসহ ২০০৭ সাল থেকে দিতে হবে।

এর অর্থ যারা কর দিতে বাধ্য হবেন, তাদের বিশাল অঙ্কের টাকা জোগান দিতে হবে। এ পরিমাণ টাকা তাদের কারও আছে বলে আমার মনে হয় না। করোনা অনেককে নিঃশেষ করেছে, কাউকে দুর্বল ও হতবল করেছে। এতদসত্ত্বেও অন্তত কয়েক ডজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় অনন্য অবদান রেখেছে। তারা উচ্চশিক্ষার দ্বার প্রশস্ত করেছে, দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ ক্ষীণ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে, যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে যাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন কিছুটা হলেও সম্ভব হয়েছে, তুলনামূলকভাবে স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষাদাতা এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি অর্থায়নকৃত তিন-চতুর্থাংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে মানের দিক থেকে ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশও আমাদের প্রায় সমসংখ্যক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের গ্রহণযোগ্যতার স্তরে ফেলেছে। এসব অবদান রাখতে গিয়ে তাদের পূর্ববর্তী সঞ্চয়ের বড় অংশ বিনিময় করতে হয়েছে। তারা বিনিয়োগ করেছে এ কারণে যে, ২০১০ সালের আইনে বলা হয়েছে, তাদের আয়ের উৎস কী হবে আর সে আয় বা উদ্বৃত্ত শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ব্যয় করা যাবে। তারা নিজের লভ্যাংশ আকারে কিছু নেননি, কেননা লভ্যাংশ নেওয়ার কোনো বিধান ২০১০ সালের আইনে নেই। তারপর ট্রাস্টের আয় যদি জনমঙ্গলমূলক হয়, তাহলে উদ্বৃত্তের ওপর কর দিতে হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা ব্যক্তি হতে পারত, সমষ্টি হতে পারত, পার্টনারশিপ হতে পারত বা সোসাইটিজ আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে পারত। ২০১০-এর আইনের আগে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় সোসাইটিজ অ্যাক্টে নিবন্ধিত হয়েছিল। ১৫ শতাংশ হারে করও দিয়েছে, অনেকেই। হয়তো কেউ মুনাফার অংশ নিয়ে থাকতেও পারে। পরে তারা অবশ্য ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করতে ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছে। ইউজিসির যুক্তিটা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে অলাভজনক আর ট্রাস্টও হবে অলাভজনক এবং সে কারণে অর্জিত উদ্বৃত্তের ওপরে কোনো কর দিতে হবে না। এ কারণে অন্য কোনো প্রকার কাঠামো বেচে না নিয়ে উদ্যোক্তারা ট্রাস্টের দিকে ধাবিত হয়েছে। এখন ট্রাস্ট অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও উদ্যোক্তাদের কর দিতে হচ্ছে কেমন করে?

অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, ২০০৭ সাল থেকে কর দিতে হবে। আয়কর বিভাগের বিশেষজ্ঞদের মতে, লভ্যাংশ দেখালে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানেরও উদ্বৃত্তের ওপর কর দিতে হবে এবং ট্রাস্ট যদি জনকল্যাণমূলক কাজে পরিচালিত না হয়, তাহলে কর দিতেই হবে। আমাদের যুক্তি হলো, আমরা যদি শিক্ষার দায়িত্ব না নিতাম তাহলে সরকারকে সে দায়িত্ব নিতে হতো আর করের বোঝায় যদি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে সরকারকে সে দায়ভার নিতে হবে। তাদের আরোহিত কর অপেক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় করতে হবে অনেক বেশি। তাদের বিদেশি শিক্ষাগ্রহণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা দিতে হবে কিংবা অনুপ্রবেশকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে দেশের শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দিতে হবে। তারা মুনাফা অর্জন করবে এবং তা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বাকিটা দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে। এ বৈষম্যমূলক অবস্থায় আমাদের সংকট বাড়বে। সহানুভূতিশীল কর্মকাণ্ডে অস্থিতিশীল অবস্থার জন্ম হতে পারে। তার চেয়ে যদি আপিল বিভাগ-হাইকোর্ট বিভাগ প্রদত্ত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করত তাহলে উদ্যোক্তাদের কষ্ট লাঘব হতো। আগের এক সিদ্ধান্তে বলা আছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর দেবে না, এমনকি যারা কর প্রদান করে ফেলেছে তাদের দেওয়া কর ফেরত দিতে হবে। পরে জেনেছি যে, আগে প্রদত্ত কর ফেরত দিতে হবে না, কিন্তু এখন থেকে আর কোনো কর নেওয়া যাবে না। সম্ভবত এ সিদ্ধান্তের পরই সবাই কর দেওয়া বন্ধ করেছে এবং সবাই আনন্দে সাগরে ভেসেছিল। আমাদের সামান্য অভিজ্ঞতা বলে, হাইকোর্টের পর সুপ্রিম কোর্ট যে সিদ্ধান্ত দেন, আপিল বিভাগে সচরাচর তা অবিকৃত থাকে। এ ধারণায় আমরা নিজেদের বেশি প্রসারিত করেছি, সংকটে পা রেখেছি এবং ২৭ ফেব্রুয়ারির সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে ডুবন্ত নৌকায় চড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আইন অন্ধ, কিন্তু আইনপ্রণেতা, আইনপ্রয়োগকারী বা সামগ্রিকভাবে দেশের সরকারকে সবসময় অন্ধ হলে চলে না। সেদিক বিবেচনা করে আমরা আপিল বিভাগে পুনর্বিবেচনার কথা তুলতে পারি। কিন্তু যেহেতু পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত হাতে আসেনি তাই রাষ্ট্রপতির নজরে বিষয়টা আনা হয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর হলেন রাষ্ট্রপতি।

যা হোক, শিক্ষার স্বার্থে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বার্থে আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে ১৫ শতাংশ কর থেকে অব্যাহতি। পরের কথা পরে। যারা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান চালাতে চায়, তাদের করবিহীন চালাতে আর যারা লভ্যাংশ নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে চায়, তাদের সে সুযোগ দেওয়া যায়। যার নজির বিশ্বে আছে।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আফগানদের বিরুদ্ধে জয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ

বৃষ্টিসহ আগামী ৫ দিনের পূর্বাভাস দিল আবহাওয়া অফিস

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি ও কার্টিন ইউনিভার্সিটির চুক্তি স্বাক্ষর

স্মার্ট কার্ডের সংকট কাটাতে আসছে ‘ব্ল্যাংক কার্ড’

সেই বিয়ের কথা স্বীকার করলেন পরীমনি

দুর্গোৎসবে টাইমস স্কয়ারে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের আবহ

‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ২০০৯’ সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি

জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার নীতিমালা সংশোধন

কর্মবিরতিতে ভেঙে পড়েছে টিকাদান কর্মসূচি

আ.লীগ নেতাকে ছিনতাই, ২২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১০

রাজশাহীতে মা-ছেলেসহ তিন মাদক কারবারি গ্রেপ্তার

১১

নীতি-আদর্শের পরিবর্তন করতে পারলেই শান্তি আসবে : ফয়জুল করীম

১২

সেভিয়ার মাঠে বিধ্বস্ত বার্সা

১৩

আন্তঃশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন কাঞ্চন একাডেমি

১৪

একই দিনে বজ্রপাতে ৯ জনের মৃত্যু

১৫

বিএনপিতে যোগ দিলেন ৫ শতাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী

১৬

মায়ের মৃত্যুর শোক শেষ না হতেই ডেঙ্গুতে ছেলের মৃত্যু

১৭

রাত ১টার মধ্যে ঢাকাসহ ১৭ জেলায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের শঙ্কা

১৮

শিক্ষক দিবসে ক্যানসারে নিভল ‘জালাল স্যারের’ প্রাণ

১৯

জিম্মিদের মুক্তি নিয়ে ইসরায়েলকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তা

২০
X