সংগীতশিল্পী অনেকেই হন, কিন্তু সংগীত-সাধক মিলবে গুটিকয়। নীলোৎপল সাধ্য ছিলেন তেমন এক ব্যতিক্রমী শিল্পীসত্তা। জন্মেছিলেন ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৫ সালে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া গ্রামে। আর আগামীকাল ১৭ মার্চ তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। নীলোৎপল সাধ্য গারো পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শিক্ষার সূত্রে নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ হয়ে একসময় ঢাকায় এসে স্থিত হন। প্রকৌশলী হিসেবে সরকারের টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন বটে, তবে পেশাগত পরিচয়ে তাকে কেউ বিশেষ চেনেনি। কণ্ঠে ও অন্তরে গান নিয়ে তিনি এসে পৌঁছেছিলেন ময়মনসিংহে, সমৃদ্ধ সংগীত-ঐতিহ্যে স্নাত শহর। সেখানে তিনি গুরু হিসেবে পেলেন নূরুল আনোয়ারকে, সংগীতগুণী ওয়াহিদুল হকের তখন প্রায়ই যাতায়াত ময়মনসিংহে, পান বন্ধু-সুজন নূরুল আনোয়ারের সান্নিধ্য আর দুইয়ে মিলে চলে নবীন শিক্ষার্থীদের তালিম দান। তারা তো কেবল গান কণ্ঠে তুলে দেন না, অন্তরে উদ্ভাসন করেন সুর ও কথার মিলনে এমন এক আকুতি; যা তাদের তাড়িত করবে জীবনভর। কী সেই দীক্ষা, কিংবা তার স্বরূপ সেসব তো ব্যাখ্যার অতীত। তবে বাস্তবে যদি যেই প্রতিরূপ খুঁজে পাওয়া যায়, সেটা আমি প্রত্যক্ষ করেছি নীলোৎপল সাধ্যের মধ্যে। উভয়ের যোগ্য শিষ্য তিনি, একদিকে গভীরতা ও অন্যদিকে অন্তরের বিস্তার, দুইয়েই তার অবগাহন।
অচিরেই শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন নীলোৎপল আর পথ চলতে শুরু করলেন ওয়াহিদুল হকের ছায়াসঙ্গী হয়ে, গানের ফেরিওয়ালা হিসেবে। মূল অবলম্বন ছিল জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, দেশব্যাপী যার বিস্তার আর প্রত্যেক শাখাতেই রয়েছে কেন্দ্র থেকে সংগীত-প্রশিক্ষক হিসেবে দক্ষ শিল্পী-শিক্ষকের আগমন ও কর্মশালা পরিচালনা। সংগীত শিক্ষাদান ও কর্মশালা বলতে সচরাচর আমরা যা বুঝি এ তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একদিকে রয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে কণ্ঠে গান তুলে দেওয়া, অন্যদিকে বাণী ও সুরের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের ভাবার্থ গূঢ়ভাবে অনুধাবন ও পরিবেশন এবং তার মাধ্যমে জীবন, জগৎ ও প্রকৃতির মেলবন্ধন উপলব্ধি ও অনুধাবন, জীবনকে বড়ভাবে জানা এবং গানের সূত্রে তা সমাজে পরিব্যাপ্ত করা। ওয়াহিদুল হকের প্রয়াণের পর সংগীত-পরিব্রাজকের দায়িত্বটি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন নীলোৎপল সাধ্য। বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা-উপজেলা নেই যেখানে নীলোৎপল নবীন-নবীনাদের নিয়ে বসেছেন, তাদের গান শেখাবেন বলে। পাশাপাশি বাংলা গানের সমৃদ্ধ ভান্ডারে অবগাহন করে সুপ্ত কিংবা অজ্ঞাত অথবা সামান্য জ্ঞাত অনেক গানের সুর তিনি আত্মস্থ করেছেন এবং এভাবে হয়ে ওঠেন পঞ্চকবির গান ও পুরোনো বাংলা গানের এক মহান সাধক। আজকে দেশের দুর্গতিপীড়িত সময়ে, সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ও গান যখন নানাভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, মৌলবাদী চিন্তার আগ্রাসী থাবায় নিজস্ব সংগীত-ঐতিহ্য থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়ছে বিশাল জনগোষ্ঠী, সাম্প্রদায়িকতায় মতিচ্ছন্ন হয়ে গানকে দিচ্ছে বিসর্জন, বিনোদনের তরল প্রবাহে গানের মধ্যে মানবসত্তার প্রতিরূপ নয়, আমোদ-স্ফূর্তির খোঁজে মাতোয়ারা, তখন নীলোৎপলকে বিশেষভাবে মনে পড়ে। দেশের নানা সমস্য-সংকটের মধ্যে সাম্প্রতিককালে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের কর্মধারার বিস্তার ও শক্তি-সঞ্চয় আশার ইঙ্গিত দেয়। এখন দেশব্যাপী পরিষদের শাখা-সংখ্যা শতকের কাছাকাছি, অনেক শাখার কর্মকাণ্ড সেখানে আশা-জাগানিয়া।
নীলোৎপল আজ নেই, কভিড সংক্রমণের গোড়ার দিকে ২০২১ সালে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু আজ যখন তার কর্মধারার বিস্তার লক্ষ করি তখন নিশ্চিতভাবে সেখানে দেখি নীলোৎপল সাধ্যকে। লম্বা ছিপছিপে গৌরকান্তি অবয়ব, হাসিতে শিশুর এক সারল্য, জীবনের আনন্দরস খুঁজে পান নবীন-নবীনাদের সুরের দীক্ষাদানে, কাঁধে ঝোলা নিয়ে নিরাভরণ নিরহংকার এ মানুষটি গানের ফেরিওয়ালা হয়ে চলছেন জেলা থেকে জেলায়, উপজেলায়, যখন যেখানে ডাক পড়েছে মনের আনন্দে ঘর ছেড়ে তিনি বাইরের পথে পা বাড়িয়েছেন, যেন এর চেয়ে আনন্দের কাজ আর কিছু নেই। জাগতিক সাফল্য বলতে আমরা যা কিছু বুঝি সেসবের কোনো পরোয়া করেননি তিনি, বেতারে টেলিভিশনে ডাক পড়লে সংগীত পরিবেশন করেছেন ঠিকই, তবে জনপ্রিয় হওয়ার কোনো অভিলাষ থেকে নয়, বরং শ্রোতার কাছে গানের সম্পদ পৌঁছে দিতে বেছে নিয়েছেন অপ্রচলিত কিংবা স্বল্পশ্রুত গান। ফলে তার গান শুনতে পাওয়া শ্রোতার জন্য হয়ে ওঠে বিরল সৌভাগ্য। আর যারা তার কাছ থেকে সংগীতের তালিম নিয়েছেন তারা তো নানা অর্থে সৌভাগ্যবান ও সৌভাগ্যবতী। গুরু-শিষ্যের এ পরম্পরা দেশজুড়ে অগণিত শিল্পী নিশ্চয়ই বহমান রাখছে এবং সেখানেই আমরা পাব নীলোৎপল সাধ্যকে। সারা দেশে চারণের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন নীলোৎপল সাধ্য, কর্মজীবনে সপ্তাহান্তে যে ছুটি প্রাপ্য তার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন সংগীতশিক্ষাদান ব্রতপালনে, স্বেচ্ছাকর্ম তো বটেই, তার চেয়েও বেশি আনন্দময় যজ্ঞ পালন। নবীন-নবীনাদের কণ্ঠে গান তুলে দিতে তার যে নিষ্ঠা, এর প্রতিফল আমরা দেখেছি রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনে, ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে, সতেজ সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী একঝাঁক নবীন শিল্পীর সম্মেলক গানের মাধুর্যে কিংবা একক পরিবেশনার সৌকর্যে। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তির বিকাশ ও সমাজের মঙ্গলসাধন কীভাবে ঘটতে পারে ওয়াহিদুল হক-নীলোৎপল কর্মসাধনা তার উজ্জ্বল পরিচয় বহন করে। এভাবেই বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতচর্চা একেবারে আলাদা মাত্রা অর্জন করেছে। গান তার ধরাবাঁধা গণ্ডির বাইরে পেয়েছে আরেক প্রসার, দেশব্যাপী অগণিত শিল্পীর নিষ্ঠাবানচর্চা এবং সুরের সাধক ছিলেন নীলোৎপল সাধ্য। তার অকালে চলে যাওয়ার বেদনা কখনো মিলিয়ে যাওয়ার নয়, তবে সেই সাধনা ও অবদানের ধারা যেন প্রবহমান থাকে, হয়ে ওঠে আরও প্রসারমান, তার দ্বারা দীক্ষিত শিল্পীরা সেটা যখন নিশ্চিত করবে, অব্যাহত রাখবে সংগীতের এমন বিশিষ্টচর্চা, বয়ে নিয়ে যাবে অযুত মানুষের অন্তরে, সেখানে সদা সঞ্জীবন ও জাগরূক থাকবেন নীলোৎপল সাধ্য।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক