মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৪, ০৩:৪০ এএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৪, ০৮:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মালির মাটির মসজিদ

মালির মাটির মসজিদ

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির মধ্য অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধশালী শহর হিসেবে ডিজেনির (স্থানীয় উচ্চারণে জেনি) সুখ্যাতি রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণামতে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২২০০ বছর আগেও এ অঞ্চলটি সমৃদ্ধ ছিল।

খ্রিষ্টীয় ১৩ শতকে এ জেনি অঞ্চলে সর্বপ্রথম মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন রাজা কিং কয় কম্বটো।কথিত আছে যে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর রাজা কিং কয় কম্বটো মহান আল্লাহর পথে নিজের জীবনের সবকিছু ব্যয় করার শপথ নেন। তারপর তিনি শহরের বাণী নদীর তীরে অবস্থিত তার বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদ গুঁড়িয়ে দেন এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা মস্ক অব জেনি বা জেনির মসজিদ রূপে পরিচিতি পায়। রাজা কিং কয়ের পরবর্তী উত্তরাধিকারী মসজিদের পাশে মিনার ও টাওয়ার নির্মাণ করেন। তারপর ধীরে ধীরে মসজিদের চারপাশের সীমানা প্রাচীর ও অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে ওঠে।

প্রায় ৬০০ বছর ধরে মসজিদটি মালি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে নিজস্ব পরিচিতি ও প্রতিপত্তি বজায় রাখে। তবে উনিশ শতকে পশ্চিম আফ্রিকায় মুসলমান রাজা ও সেনাপতিদের মধ্যে ঐক্যের বদলে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব, অভিযোগ ও ব্যক্তিগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় মসজিদের জৌলুস ও গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৮৩৫ সালে মুসলমান শাসক ও সেনাপতি রাজা চি কৌ এমান্ডাও মতান্তরে (সেকু আমাদু) অন্যত্র শহর ও ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিলে মসজিদটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়।

তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই (১৯০৬-০৭) ঐতিহাসিক ও প্রখ্যাত এই মসজিদের পুনর্নির্মাণ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা শহরের তথা মালির অন্যতম দর্শনীয় স্থাপনা হয়ে ওঠে।

১৯০৬ সালে মালি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ফরাসি উপনিবেশে পরিণত হয়। তখনই মালির দায়িত্বে থাকা ফরাসি প্রশাসক আদি মসজিদটি পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেন বলে ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে।

জনশ্রুতি মোতাবেক ফরাসিরা মসজিদ নির্মাণে যুদ্ধবন্দি ও দাস-দাসীদের কাজে লাগান এবং অনেককেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রম প্রদানে বাধ্য করেন। এ সময় মসজিদের কিবলার দিকে প্রতিটি ১৬ মিটার উচ্চতা তিনটি দৃষ্টিনন্দন টাওয়ার নির্মিত হয়। তবে মসজিদ নির্মাণে অনেক ক্ষেত্রে পুরাতন নকশা অনুসরণ না করায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফরাসি নকশা এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ের নকশা অনুসরণ করায় স্থানীয় মুসলমানদের একটি অংশ অসন্তুষ্ট ছিল। এর জের ধরে স্থানীয় মুসলমানরা কিছুদিনের জন্য মসজিদে যাতায়াত এমনকি মসজিদটিকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা থেকেও বিরত থাকে। পরে ধীরে ধীরে মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝি ও অভিমানের অবসান ঘটে এবং মসজিদটি মুসলমানদের একটি প্রিয় সমাবেশস্থলে পরিণত হয়।

বর্তমান অবয়বের বিশাল এ মসজিদ নির্মাণে মূলত কাদা ও রোদে শুকানো ইট (যা স্থানীয় ভাষায় ফেরি নামে পরিচিত) ব্যবহৃত হয়েছে। কাদা দিয়েই মসজিদের দেয়ালসহ বিভিন্ন অংশ লেপাই (প্লাস্টার) করা হয় আর তালপাতা ও পাতাসংলগ্ন ডালা ব্যবহার ব্যবহৃত হয় দেয়ালের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে। তালগাছের কাণ্ড কেটে তৈরি করা লম্বা কাঠের বাতার ওপর কাদা মিশিয়ে মসজিদের ছাদ নির্মিত হয়েছে। মসজিদের মেঝে (ফ্লোর) নির্মাণের সময় ব্যবহার করা হয় স্থানীয় বালু ও কাদার মিশ্রণ।

মসজিদটির পূর্বদিকে পবিত্র কাবাঘরের অবস্থা। তাই এ মসজিদের মুসল্লিরা মূলত উত্তর দিক থেকে প্রবেশ করেন এবং পূর্বমুখী হয়ে নামাজ আদায় করেন। আগেকার দিনে মসজিদে ইমাম দাঁড়ানোর নির্ধারিত স্থানের ওপর একটি ফাঁকা অংশ ছিল। এই ফাঁকা অংশ বরাবর ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতেন আরেকজন ধর্মীয় নেতা, যিনি নিচে থাকা ইমাম সাহেবের বয়ান ও নামাজের জন্য উচ্চারিত দোয়া শুনে পুনরায় তা জোরে জোরে উচ্চারণ করতেন এবং আশপাশের সবাই সেই উচ্চারণ শুনে নিজেদের পরিশুদ্ধ করতেন ও নামাজ আদায় করতেন।

জেন মসজিদ মালিবাসীর ঐতিহ্য ও অহংকারের মূর্ত প্রতীক। প্রতি বছর উৎসবের মধ্য দিয়ে মসজিদটি মেরামত ও সংস্কার করা হয়। এ সময় স্থানীয় মহিলারা গর্তে পানি ঢেলে মাটির কাদা তৈরি করেন এবং পুরুষরা দৌড় প্রতিযোগিতা করে সেই কাদা মসজিদ সংস্কারের জন্য আগে থেকে অবস্থান নেওয়া স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে পৌঁছে দেন। এরপর চলে বিগত এক বছরে ক্ষয় হয়ে যাওয়া অথবা নষ্ট হওয়া মসজিদের অংশের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। অত্যন্ত উৎসবের আমেজে মালিবাসী এ সংস্কারকাজ করে থাকেন। এ মসজিদের আদলে ১৯৩০ সালে ফ্রান্সের ফ্রিজাস এলাকায় সিমেন্ট দিয়ে লাল রঙের আরেকটি মসজিদ নির্মিত হয়। ১৯৮৮ সালে ইউনেসকো জেনির এই মাটির মসজিদকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশিদের স্বল্প খরচে চিকিৎসা দেবে ভারতের মণিপাল হাসপাতাল

ঢাকায় বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে আজও

যশোরে ছুরিকাঘাতে কলেজছাত্র খুন

এসএসসির ফল দেখবেন যেভাবে

১২ মে : নামাজের সময়সূচি

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

বিশ্ব মা দিবস আজ

হঠাৎ রঙিন হয়ে উঠলো রাতের আকাশ

আজ থেকে বাসের ‘গেটলক সিস্টেম’ চালু

এসএসসি ও সমমানের ফল জানবেন যেভাবে

১০

‘প্রত্যেক নারী পাবেন ১ লাখ করে ভাতা’

১১

বিশ্ব মা দিবস / মিসেস গুলশান আরা বেগম স্মরণে ‘তুমি হাসিছো কাঁদিছি মোরা’

১২

রাবিতে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ

১৩

এসএসসির ফল ঘোষণা আজ

১৪

৩৫ প্রত্যাশীদের আমরণ গণঅনশন

১৫

আজ থেকে নতুন দামে কিনতে হবে সোনা 

১৬

দুঃসংবাদ দিল আবহাওয়া অফিস

১৭

রিয়াল বিক্রির নামে প্রতারণা, মূলহোতা ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

১৮

পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু

১৯

ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল নারীর

২০
X