দেশে সরকারি প্রকল্পের টাকা নয়ছয়, বিভিন্ন অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ঘটনা নতুন নয়। সুপেয় পানির সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সালে শুরু হওয়া ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ প্রকল্পটির বেলায়ও এই চিত্র ভিন্ন কিছু নয়। হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি ঘিরেও চলছে নানারকমের নয়ছয়। অধিকাংশ সরকারি প্রকল্পের এই দশা কি নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে? এটি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ও দুঃখজনক।
রোববার দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত প্রধান শিরোনামে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিতে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে শুরু হয় ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ প্রকল্পটি। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। সেই হিসেবে প্রকল্পের কাজ যথাযথ উপায়ে শেষ করতে যেখানে কাজের গতি বৃদ্ধি হওয়ার কথা, সেখানে হয়েছে উল্টোটা। এরই মধ্যে উঠেছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। প্রায় সব এলাকায় উপকারভোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের কারণে অনেক পানির ট্যাঙ্ক ও ট্যাপ এরই মধ্যে নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুপেয় পানি সংরক্ষণসামগ্রী পাচ্ছেন অসহায় পরিবারের পরিবর্তে প্রভাবশালী ও বিত্তবানরা। এ ছাড়া এরই মধ্যে বাস্তবায়িত অংশের অনেক জায়গায় সংরক্ষণ ও তদারকির অভাবে ট্যাঙ্কঘর নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে গোয়ালঘর, হাঁস-মুরগি পালনের ঘর হিসেবে। এ ছাড়া ২০ শতাংশ কাজ করে ৮০ শতাংশ বিল তুলে নেওয়া হয়েছে। ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারের চার উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ৯ হাজার ৮৬৯টি বাড়িতে পানির ট্যাঙ্ক বসানো হচ্ছে। সরকারি খাতে সহায়ক চাঁদার নামে প্রতি উপকারভোগীর কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা, যা সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে অনেক বেশি। এই খাতে অতিরিক্ত প্রায় ১ কোটি টাকা আদায় ও আত্মসাৎ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ট্যাঙ্কের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে প্রথম শ্রেণির ইটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির ইট। নিম্নমানের বালু ও প্রয়োজনের চেয়ে কম সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। এ চিত্র অধিকাংশ জায়গায় অভিন্ন।
আমরা জানি, নির্ধারিত সময়ে সরকারি প্রকল্প সমাপ্ত না হওয়া, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি এবং কোনো কোনো প্রকল্প আলোর মুখ দেখার আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা রয়েছে অগণিত। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে অধিকাংশ প্রকল্পের পরিণতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম না হওয়া— স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকল্পের নামে জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ আর কত! নতুন নতুন প্রকল্পে সংশ্লিষ্টদের অতি আগ্রহ দেখা গেলেও বাস্তবায়নে তাদেরই অনাগ্রহের বিষয়টি দুঃখজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা কেউই দায় এড়াতে পারেন না। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কেন এমনটা ঘটছে, তা খুঁজে বের করার পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা এ অচলাবস্থার অবসান জরুরি। একদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে উপকূলীয় জেলাগুলোয় সুপেয় পানি সংগ্রহে রীতিমতো লড়াই করছে সাধারণ মানুষ; অন্যদিকে ভুক্তভোগীদের অসহায়তার সুযোগে চলছে কিছু মানুষের অর্থলাভের মচ্ছব। এটি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের প্রত্যাশা, সরকারি প্রকল্পগুলো যেন সত্যিকারই মানুষের কাজে লাগে, অর্থাৎ প্রকল্পের লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জিত হয়, এটি বিশেষভাবে ভাবতে হবে। পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের চলমান প্রকল্পের যথাযথ লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে সব অনিয়ম ও প্রতারণার বিষয় খতিয়ে দেখা এবং জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে, এটাই চাওয়া।