আকমল হোসেন
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ২০ মে ২০২৪, ০৭:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার চ্যালেঞ্জ

বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার চ্যালেঞ্জ

সম্প্রতি রাজধানীর অভিজাত অঞ্চল গুলশানের অভিজাত এক হোটেলে ‘বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শিরোনামে একটি নাগরিক সমাজের প্ল্যাটফর্মের আয়োজনে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্য, উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা শিক্ষা ও সমাজ গবেষক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবক, যুবসমাজের প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের আহ্বান করা হয় সেখানে। রাষ্ট্র বা সরকারের নীতিনির্ধারক আমন্ত্রিত মন্ত্রী ও জাতীয় সংসদ সদস্য ছাড়া সব শ্রেণির প্রতিনিধিই উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মধ্য আয়ের দেশ, স্বাধীনতা নেতৃত্বদানকারী একটি দলের সরকারের নিরবচ্ছিন্নভাবে তিন টার্মে ক্ষমতাসীন থাকার পরও যখন বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু-কিশোরদের পড়ার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ ও সেটা সমাধানের পথ বের করতে কনসালটেশন সভা করতে হয়, তখনই নতুন ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা দেখা দেয়। তাও আবার বঞ্চিতদের জন্য অভিজাত হোটেলে বসে সমাধানের চেষ্টা!

বিদ্যালয়বহির্ভূত এ শিশু-কিশোরদের সংখ্যা একেবারেই কম নয়, সংখ্যার হিসাবে ৪১ শতাংশ, যাদের বয়স ৫ থেকে ২৪ বছর। প্রাথমিক শিক্ষায় যখন ৮ বছর (প্রথম-অষ্টম শ্রেণি) বা ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত। মাধ্যমিক শিক্ষার সময় ৪ বছর (নবম-দ্বাদশ শ্রেণি) এবং শিক্ষার্থীদের বয়স ১-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। ২৪ বছর পর্যন্ত হলে উচ্চশিক্ষা স্তরের শিক্ষার্থীদেরও বড় একটা অংশ এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। সেখানে অনার্স ও মাস্টার্স (৪+১) ৫ বছর এবং শিক্ষার্থীর বয়স ১-২৩ বছর। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই, মেধায় যারা ভালো তারাই সেখানে পড়বে। মেধা না থাকলে তাদের জন্য উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার দায়বদ্ধতা রাষ্ট্র বা সরকারের নেই। তবে মেধাবী শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে দুর্বল হলে এবং ওই শিক্ষার্থী পড়তে চাইলে রাষ্ট্র তাকে পড়াতে বাধ্য, সেটা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ডিক্লারেশন ও দেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে জাতির প্রতি সরকারের অঙ্গীকারের দলিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা সব দেশের সংবিধানে, আন্তর্জাতিক ডিক্লারেশনে এবং দেশের জাতীয় শিক্ষানীতিতে নিশ্চিত করার অঙ্গীকার আছে রাষ্ট্রের। এ শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তি, কমিউনিটি ও রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। ব্যক্তি ও কমিউনিটি যদি প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারে, সেখানে রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। কারণ রাষ্ট্র জনগণের কাছ থেকে খাজনা ও কর নিয়ে থাকে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলবহির্ভূত শিশু-কিশোরদের মধ্যে ড্রপ-আউট হওয়া এবং কখনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা ১৩.৯৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৩৫.৯৮ শতাংশ। এ শিশু-কিশোররা প্রথমত পিতা-মাতার আর্থিক সংকটের কারণে, দ্বিতীয়ত ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চর, হাওর, পাহাড়ি অঞ্চল, বস্তি অঞ্চলের শিশু-কিশোর এ তালিকায় যুক্ত। দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তবে উন্নয়নের চেয়ে বৈষম্য বেড়েছে। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার কারণে তারা সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারছেন না। বিদ্যালয়ের বাইরে থাকার প্রধান কারণই হচ্ছে পিতা-মাতার আর্থিক সংকট। এ সমস্যা সমাধানের জন্য এদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বিদ্যালয়ে ভর্তি/ইনরোলমেন্টের মতোই প্রাথমিকে ২.৪৪ শতাংশ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৬.২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় না অথবা হতে পারে না। ২০০০-২০১৫ সালে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের দ্বিতীয় ধারায় সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনুষ্ঠানিক উপ-আনুষ্ঠানিক (এনজিও স্কুল) বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম এগোলেও বর্তমানে সেটা এখনো শতভাগ হয়নি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও যদি আর্থিক সংকটের কারণে অভিভাবক তার সন্তানকে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয় বহন করতে না পারে, রাষ্ট্রও সেখানে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে না, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা বলে, তখন মধ্য আয়ের দেশের গৌরবের কথা বলার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু? সেটা অনেককেই ভাবায়। মধ্য আয়ের দেশের প্রস্তাবনার বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী যারা শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে এনজিওদের আর্থিক সুবিধা দিত, তারাও মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার কারণে এ খাতে আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে, আবার অনেক খাতে বন্ধ করে দিয়েছে। আবার বিদ্যালয়বহির্ভূতদের শিক্ষার আওতায় আনতে ব্যুরো অব নন-ফরমাল এডুকেশনেও অর্থায়ন কমানো হয়েছে, যা ওই সভায় ওই দপ্তরের প্রধান ব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে সেটা সমাধানের চিন্তা না করে ড্রপ-আউট যাতে না হয়, সেদিকে সজাগ হওয়ার কথা বলেন। সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব এনজিও বা কোনো সংস্থার কাছে দেওয়ার পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে কাজটি করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। ১৯৪৮ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ২৬ ধারায় প্রফেশনাল ও কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের শর্তে সব রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও তার বাস্তবায়ন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়নি, যার কারণে মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে। সরকার নীতিগত দিক থেকে বারবারই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করছে না। আন্তর্জাতিক ডিক্লারেশন, দেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার কারণে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ব্যক্তির অর্থনৈতিক সংকট আর সেই সংকটের কারণে নানাভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের সন্তানরা আজ বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষার্থীর তালিকায়। ১৯৬০ সালে জাপানে, আমেরিকার উন্নয়নের সঙ্গে নিজেদের উন্নয়নের তুলনা করে এবং তাদের শিক্ষায় জাতীয় বাজেটের ৪১ ভাগ বরাদ্দ করে, ১৯১১ সালে এসে তার সামগ্রিক উন্নয়নের পর্যায়ে উপনীত হয়। সেটা দেখে কোরিয়া, তাইওয়ান, চীন, মালয়েশিয়া তাদের শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি করে, যার সুফল তারা ভোগ করছে।

অথচ ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশে শিক্ষার বরাদ্দ জিডিপি ১.৬৭ (২০২১-২৪) শতাংশ। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব জিডিপির ৫ ভাগ এবং জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ করলে স্বাধীনতায় ৫৩ বছরে বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষার্থীর শিক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বারবার কনসালটেশন প্রয়োজন হতো না আর রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা সেখানে উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেও অকারণে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দোষে দোষী হতো না। আমরা যদি সত্যিকারই এ মানুষগুলোর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে সামগ্রিকভাবেই একটা কিছু করা দরকার। স্বাধীন দেশের সুফল পাওয়ার অধিকার শিক্ষাবঞ্চিত ওই শিশু-কিশোরদেরও আছে। এ বঞ্চনা দূরীকরণে কনসালটেশনের নামে আর কতবার তাদের এ ধরনের লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আর আমাদের সম্মানিত রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের কনসালটেশনে আসার কথা বলে না আসার জন্য শরম পেতে হবে।

লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইনসাফের বাংলাদেশ গড়তে দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই: বুলবুল

চবি ভিসিকে শিক্ষার্থী / ‘নিজের যোগ্যতায় বসেননি, আমরা আপনাকে বসিয়েছি’

সিভাসুর ২ শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল, বহিষ্কার ১৯

জবির মার্কেটিং বিভাগের ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

মান্না ছিলেন বাংলাদেশের ‘জেমস বন্ড’ : জাহিদ হাসান

করাচিতে ভবন ধস, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৯

আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে : সালাহউদ্দিন

১৩-০! শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের যুবারাদের

আধুনিক জীবনে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কৌশল

রাজধানীতে বিএনপি নেতা নীরবের লিফলেট বিতরণ

১০

এখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় খুলতে দেওয়া হবে না : হেফাজতে আমির

১১

সাঁকো দিয়ে ব্রিজে উঠেন ১০ গ্রামের মানুষ

১২

তিন ম্যাচে ১৬ গোল দিয়ে এশিয়া কাপে বাংলাদেশ

১৩

খিলক্ষেত থেকে জনতা ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক নিখোঁজ

১৪

বিপদ থেকে রক্ষা পেলেন বিমানের ৩৮৭ যাত্রী

১৫

মিরপুরে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প 

১৬

সংসদ নির্বাচন আটকানোর শক্তি কারও নেই : গয়েশ্বর

১৭

বৈষম্যবিরোধী নেতার বিরুদ্ধে ‘চাঁদাবাজির’ অভিযোগ

১৮

এবার সন্তানের গলায় ছুরি ধরে মাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

১৯

প্রাথমিকের শিক্ষকদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

২০
X